পারিবারিক নির্যাতন-বিচারের বাণী যেন নীরবে না কাঁদে by আসাদ উল্লাহ খান

গত এক মাসেরও বেশি সময় আমি অসুস্থ ছিলাম। এনলার্জড প্রস্টেটের কারণে সার্জারির পর নানা ধরনের জটিলতা কাটছে না। আমার অসুস্থতার খবর পেয়ে বন্ধু গণপূর্ত বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী গোলাম মওলা আমাকে দেখতে এলেন।


গত ১৪ জুন রুমানা মনজুরের ওপর তাঁর স্বামীর পাশবিক নির্যাতনের কাহিনি পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর এ ঘটনা যেকোনো বাসায়, চায়ের টেবিলে কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে একটি আলোচিত বিষয়। হাসান সাইদ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করলেও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে কিংবা অন্য কোনো অজ্ঞাত কারণে ডিগ্রি না পেলেও ইঞ্জিনিয়ার পরিচয়ে রুমানাকে বিয়ে করেন। রুমানার ভাষ্যমতে, হয়তো বিয়েটা রুমানার পছন্দে হয়েছে। শিক্ষিত সমাজের গণ্ডিভুক্ত হয়ে মোটামুটি লেখাপড়া জানা একটি ছেলে রাগ, বিদ্বেষ কিংবা প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে স্ত্রীর ওপর এ ধরনের পশুর মতো আচরণ করতে পারেন, তা বিশ্বাস করাই যায় না। টিভিতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক কিংবা Animal planet ছবিতে শক্তিধর বাঘ, সিংহজাতের পশুকে দুর্বল পশুর ওপর এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে কামড়ে, খাবলে পর্যুদস্ত করতে দেখেছি। রুমানার মুখমণ্ডল, নাক ও চোখের অবস্থা টিভির ছবিতে দেখে অনেকের মনে হয়েছে, আমরা সুন্দরবন কিংবা আফ্রিকার কোনো জঙ্গলে বাস করছি কি না?
গোলাম মওলার বয়স এখন ৭৪। এই বয়সের একজন মানুষ, যাঁর নিজের কোনো কন্যাসন্তান নেই, তিনি এক নারীর বেদনায় এতটা কাতর, এতটা অনুভূতিপ্রবণ হতে পারেন, তা আমি ধারণাও করতে পারিনি। গোলাম মওলা আমাকে বললেন, ‘আপনি তো লেখালেখি করেন, রুমানার ওপর তাঁর স্বামী নামধারী এই বর্বর পুরুষটির নৃশংসতা নিয়ে একটু লেখেন।’ তিনি হয়তো চিরাচরিত সত্যি কথাটাই বলেছিলেন। তাঁর কথা উদ্ধৃত করে বলতে চাই, সময় কিছুটা পার হয়ে গেলে আমাদের আবেগ যেমন থিতিয়ে যায়, প্রশাসনিক তৎপরতা এবং বিচারপ্রক্রিয়ার গতিশীলতাও থেমে যায়। তাই সমাজ, রাষ্ট্রযন্ত্র ও বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীকে প্রতিনিয়ত শব্দের শাণিত অস্ত্রের আঘাতে জাগ্রত করা প্রয়োজন। গোলাম মওলা অত্যন্ত আবেগজড়িত কণ্ঠে আমাকে বললেন: দেশ, রাষ্ট্র ও সমাজ দুর্নীতি, অনাচার ও ক্ষমতার অপব্যবহারে যতই কলুষিত হোক না কেন, এ অবক্ষয় থেকে টেনে তোলার প্রচেষ্টা থেকে আমরা পিছিয়ে থাকতে পারি না।
এ দেশের প্রত্যেক বিবেকবান ও সংবেদনশীল মানুষ, এমনকি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখানে শিক্ষা ও আমাদের শহুরের এ সভ্যতার আলো পৌঁছায়নি—এমন একটি গ্রামের মানুষও রুমানা মনজুরের ওপর এই পাশবিক নির্যাতনের খবর পত্রিকা কিংবা টিভির সংবাদচিত্র দেখে শুধু ব্যথিত হয়েছে বললে কম বলা হবে, তারা আতঙ্কিত হয়েছে। একটি শিক্ষিত ও ধনাঢ্য পরিবারের সুদর্শন বেকার ছেলে ১০ বছর শ্বশুর কিংবা স্ত্রীর ঘাড়ে চেপে বসে থেকেই ক্ষান্ত হননি, বুয়েট থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত বলে তিনি স্ত্রী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। এতটা গলগ্রহ হয়ে থাকার পর তাঁর আশ্রয়দাতা, তাঁর ঢাকা শহরে চলাফেরার জন্য অর্থ জোগানদাতা স্ত্রীর ওপর এতটা পশুর মতো আচরণ করার ব্যাপার শুধু অকল্পনীয় নয়, এ ধরনের বর্বর আচরণ সভ্য সমাজে মেনে নেওয়া অসম্ভব।
রুমানার দেওয়া বিবরণ থকে জানা যায়, প্রতারক স্বামী ১০ বছর ধরে সময়ে-অসময়ে তাঁর ওপর নির্যাতন করেছেন। রুমানা তাঁকে পছন্দ করে বিয়ে করেছেন বলে নিজের দুর্বলতা চেপে রেখে, অর্থাৎ স্বামীর নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ হলে পারিবারিক সম্মান, মর্যাদা ও ঐতিহ্য নষ্ট হবে এবং সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হবে—এটা ভেবে রুমানা দিনের পর দিন সব অত্যাচার, নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করে গেছেন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হলেও স্ত্রীর চোখে আঙুল ঢুকিয়ে চোখ উপড়ে ফেলতে এবং নাক ও মুখমণ্ডল দংশন করে ক্ষত-বিক্ষত করতে তাঁর কোনো অসুবিধা হয়নি। রুমানা মনজুর পরাজিত হলেন। রুমানা মনজুর আজ জীবিত থেকেও মৃতপ্রায়। কারণ, সৃষ্টির এমন লীলাখেলা যে একজন মানুষের মেধা, মনন, দক্ষতা, দৈহিক সক্ষমতা এসব কিছু থাকলেও চোখের দৃষ্টি যদি না থাকে, তাহলে এ পৃথিবীতে তথা এ সংসারে তিনি পুরোপুরি অসহায়। এ যন্ত্রণা আঁচ করা যায়, কিন্তু প্রশমন করা যায় না।
সবচেয়ে বেদনার বিষয় হলো, রুমানার সাড়ে পাঁচ বছরের ফুটফুটে সুন্দর অবুঝ মেয়েটি যখন বুঝতে পারবে, বাবার কারণে তার মা অন্ধ হয়ে গেছেন, তাকে দেখতে পান না—তখন বাবার প্রতি তার মনে যে ঘৃণা, ভয়, ক্রোধ, অশ্রদ্ধা ও বীতস্পৃহা সৃষ্টি হবে, তা কীভাবে নিরোধ করা যাবে? এ ভাবনা তার হূদয়কে প্রতিনিয়ত দলিতমথিত করবে।
মেয়েটির বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন বুঝতে পারবে যে বাবার কারণে মায়ের জীবনে এই অন্ধকার নেমে এসেছে, তখন তার মায়ের প্রতি বেদনাবোধ এবং বাবার প্রতি ঘৃণা আরও বেড়ে যাবে।
আমাদের দেশের সামাজিক ধারা, পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক সুস্থিতি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য অধিকাংশ নারী সংসারে দিনের পর দিন নিগৃহীত হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবাদী হতে পারেন না। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিপন্ন হলেও যেকোনো সংসারে স্ত্রী কিংবা মায়ের কাছে যে প্রশ্নটা বড় হয়ে দাঁড়ায়, সেটা হলো সাংসারিক এই যন্ত্রণা। এই নিগ্রহ যেন সন্তানের মনে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে না পারে। এই যুদ্ধে জয়ী হতে গিয়ে রুমানা মনজুর হেরে গেছেন।
এই বর্বরোচিত ঘটনার নিপীড়ক সাইদ গ্রেপ্তার হয়েছেন। রিমান্ডে নিয়ে তাঁর স্বীকারোক্তিও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখানেই সব শেষ হলে চলবে না। মানুষ তাকিয়ে আছে বিচারালয়ের দিকে। হাসান সাইদের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়, তাহলে হয়তো আগামী দিনে এরূপ বর্বরোচিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।
আসাদ উল্লাহ খান: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক।

No comments

Powered by Blogger.