মিডিয়া ভাবনা-হরতাল নিয়ে নতুন চিন্তা by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

কী করে জানি না, হরতালের মতো একটি নেতিবাচক ও ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি আমাদের রাজনৈতিক দলের অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সাম্প্রতিককালে হরতালের আগের রাতে আট-দশটি গাড়ি পোড়ানো আরেকটি অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।


বিদেশে হরতালের মতো কোনো কর্মসূচি দেখা যায় না বলে তাদের দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটি কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি করে না। আমাদের দেশে হরতালও আছে, আবার দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটিও আছে। কী মজা! বড় তিন-চারটি রাজনৈতিক দল তাদের পেশিশক্তির জোরে গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে সারা দেশের মানুষের কাজকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিকতা তথা স্বাভাবিক জীবনযাপন জিম্মি করে ফেলেছে।
ছয় ঘণ্টা থেকে ৪৮ ঘণ্টা তারা সমগ্র দেশকে বন্ধ করে রাখতে পারে। গণতন্ত্রের চর্চার এ রকম নমুনা ও রাজনৈতিক দলের এ রকম অধিকার সারা পৃথিবীতে এক ‘পশ্চিমবঙ্গ’ ছাড়া কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কাকতালীয় হলেও আমরা উভয়ে বাংলাভাষী। কী অদ্ভুত মিল!
৩০ বছর ধরে আমি সুযোগ পেলেই হরতালের বিরুদ্ধে লিখেছি। আমি এখনো মনে করি, আইন করে হরতালের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি নিষিদ্ধ করা উচিত। যদিও কয়েকটি রাজনৈতিক দল হরতালকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার মনে করে। শুধু আমি নই, দেশের লাখ লাখ লোক হরতালবিরোধী। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। কারণ, এই লাখ লাখ লোক পেশিশক্তির চর্চা করে না এবং তারা সংগঠিত নয়। কাজেই কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে হরতাল নিষিদ্ধ হবে বলে আমার মনে হয় না। সাধারণ মানুষ, যারা হরতালবিরোধী, তারা ভয়ে নিজের প্রাণ ও সম্পদ রক্ষার স্বার্থে হরতালে পরোক্ষভাবে যোগ দেয়। রাজনৈতিক দল দাবি করে, এটা তাদের অতি সমর্থন। একটা লোকও এ কথা বিশ্বাস করে না। কাজেই অন্য সবার মতো আমিও হরতাল মেনে নিয়েছি। বাংলাদেশে গণতন্ত্র মানলে হরতাল মানতে হবে।
কিন্তু হরতালের তথাকথিত অধিকার বজায় রেখেও এর ধ্বংসাত্মক ও নেতিবাচক দিক কমানো যায় কি না, তা নিয়ে একটু গবেষণা করা যায়। আমার ধারণা, বড় চার-পাঁচটি দলের ভেতরেও অনেকে হরতালের নেতিবাচক দিক নিয়ে পীড়িত। কিন্তু অধিকারের মোহে হরতালের মায়া কাটাতে পারছেন না।
হরতালের একটা নতুন চেহারা দেওয়া যায় কি না, এ ব্যাপারে আমার একটা চিন্তা আছে। সেটা বলার জন্য আজ এই লেখার অবতারণা।
হরতাল যাঁরা ডাকেন, তাঁদের কিছু দাবি থাকে সরকারের প্রতি। সরকার ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে তাঁদের দাবিও থাকে না, ক্ষোভও থাকে না। এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত আশা করি নেই।
তাহলে আমরা কি শুধু সরকারের বিরুদ্ধে হরতাল পালন করতে পারি না? জনগণকে হরতাল কর্মসূচির বাইরে রাখলে কেমন হয়? হরতালের চেহারাটা কি এ রকম হতে পারে—সরকারি অফিস ও সরকারি যানবাহন ওই দিন চলতে পারবে না, শুধু সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান ও যানবাহন ছাড়া। যত পিকেটিং, সব সরকারি অফিসের সামনে। এটা করা হলে দাবি আদায়ের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যায়। একটি দিন সরকার কোনো কাজই করতে পারল না। এটাই তো হরতালের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। হরতালের লক্ষ্য নিশ্চয়ই দরিদ্র মানুষকে কষ্ট দেওয়া নয়। সাধারণ মানুষকেও কষ্ট দেওয়া নয়। ব্যবসায়ীকে কষ্ট দেওয়া নয়। (ব্যবসায়ীদের টাকায়ই তো রাজনৈতিক দল চলে।) বিদেশ-ফেরত বিমানযাত্রীদের কষ্ট দেওয়া নয়। কষ্ট যদি দিতেই হয়, তাহলে সরকারকে দেওয়া উচিত। আরও কী কীভাবে সরকারকে কষ্ট দেওয়া যায়, তা নিয়ে গবেষণা করা যায়। গাড়ি পোড়াতে হলে সরকারের গাড়ি পোড়ানো কি ভালো নয়? সরকার চাইলে পরদিনই নতুন মডেলের আরেকটি গাড়ি কিনে নিতে পারে। পাবলিকের গাড়ি পুড়িয়ে রাজনৈতিক দলের কী লাভ? কোনো লাভ হয় না। বরং একজন সাধারণ মানুষ, তিনি ওই দলেরই সমর্থক হতে পারেন, তাঁকে সর্বস্বান্ত করা হলো। এর মাধ্যমে হরতালের সার্থকতা কোথায়? আমি গাড়ি পোড়ানোর অধিকার নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলছি না। গণতন্ত্র মানলে গাড়ি পোড়ানো মেনে নিতে হবে। আমি শুধু বলছি, পোড়াতে হলে সরকারের গাড়ি পোড়ালে তা হরতাল আহ্বানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়।
হরতাল পালন করা রাজনৈতিক দলের অধিকার। এটা এখন প্রতিষ্ঠিত। আমাদের দেশ গরিব, আমরা বিদেশ থেকে ঋণ করে খাই, আমাদের অর্থনীতি নড়বড়ে, দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে, তবু হরতাল আমাদের অধিকার! আমরা যারা সাধারণ, তারা তো বড় তিন-চারটি রাজনৈতিক দলের কাছে জিম্মি। তারা যা বলবে, তা আমাদের মেনে নিতে হয়। কারণ, আইন করার ক্ষমতা কেবল নির্বাচিত রাজনীতিবিদেরই আছে। আমাদের নেই। তাই আমরা অসহায়।
তারা যদি হরতালকে শুধু সরকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে, তাহলে দেশের জনগণ রাজনৈতিক নেতাদের জিন্দাবাদ দেবে। সরকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক অধিকারও রক্ষা হয়, জনগণও বেঁচে যায়। দেশের কিছু ক্ষতি হয়তো হবে। দেশের উন্নতির কথা সব রাজনীতিকই ভাবেন, এটা আমি বিশ্বাস করি না। তবে, বড় দলের প্রায় শতভাগ রাজনীতিকই নিজের ও পরিবারের উন্নতির কথা ভাবেন।
দেশের আইন, বিচারব্যবস্থা, পুলিশ, র‌্যাবসহ কোনো কিছুই হরতালের ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি বন্ধ করতে পারেনি। এতে মনে হয়, এগুলো সবই ফাঁকা। কঠিন কিছু নয়। কেউ এগুলোকে ভয় পায় না। তাই বর্তমান সরকার ভ্রাম্যমাণ আদালত চালু করেছে। এটা কতটা আইনসম্মত, তা আইন বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন বা ভ্রাম্যমাণ আদালতের ভয়ে গাড়ি পোড়ানো, গাড়ি ভাঙা, দোকান ভাঙা বন্ধ হয়েছে তার প্রমাণ পাচ্ছি না। কাজেই মনে হয়, ভ্রাম্যমাণ আদালত তেমন কার্যকর হচ্ছে না। হরতালের নামে গাড়ি ভাঙা, গাড়ি পোড়ানো, দোকান ভাঙা, পথচারীদের অপদস্থ করা, রিকশা পাংচার করা ইত্যাদি অপরাধের জন্য হাতেনাতে ধরে তাকে ঘটনাস্থলেই শাস্তি দিতে পারলে কিছুটা কাজ হতো বলে মনে হয়। জেলকে অনেকে শাস্তি বলে মনে করে না, শারীরিক শাস্তিকে অনেকে ভয় পায়। আমি জানি, অনেকে বলবেন, এতে অনেক নিরপরাধ ব্যক্তি শাস্তি পেতে পারেন। কিন্তু গাড়ির বা ব্যবসায়ীদের অপরাধ কী ছিল, তা তাঁরা বলতে পারবেন না। হরতালের জন্য সারা দেশে লাখ লাখ মানুষ যে ভোগান্তির মধ্যে পড়ে, তা যেন কোনো মানবাধিকারের বিষয় নয়। সবাই রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করতে ব্যস্ত। হরতালের নামে ধ্বংসাত্মক কাজ করা, মানুষকে ভয়ভীতি দেখানো, অপদস্ত করা ইত্যাদি অপরাধ যারা করবে, তাদের চরম দণ্ড দেওয়া দরকার। হরতাল ডাকা কোনো দলের অধিকার হতে পারে, কিন্তু গাড়ি বা দোকান ভাঙা কারও অধিকার হতে পারে না।
তবে এসব কথার কোনো মূল্য নেই। কারণ, গণতান্ত্রিক সরকার ও তাদের পুলিশ অন্য দলের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করতেই ব্যস্ত। সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত জনবলও সরকারের নেই। সে রকম ইচ্ছা আছে বলেও মনে হয় না। কাজেই হরতালকে শুধু সরকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার প্রস্তাবটি নিয়ে এখন ক্যাম্পেইন করা যেতে পারে। তাতে রাজনৈতিক দলের অধিকার রক্ষা হবে এবং জনগণের আর্থিক ক্ষতি ও ভোগান্তি অনেকটা হ্রাস পাবে। রাজনৈতিক দলের হরতাল ডাকার গণতান্ত্রিক অধিকারকে সমুন্নত রাখার জন্য পুরো জাতিকে মূল্য দিতে হচ্ছে। মূল্যটা যাতে একটু কম দিতে হয়, সে জন্য আমার এই বিনীত প্রস্তাব। আশা করি রাজনৈতিক নেতারা বিষয়টি ভেবে দেখবেন।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়ন ও মিডিয়াকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.