অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সিপিডি-নেতৃত্বমূলক ভূমিকা নেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের

দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা চলছে। আর এ বিশৃঙ্খলার পেছনে রয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত এ মন্ত্রণালয় কোনো নেতৃত্বমূলক ভূমিকা পালন করতে পারছে না। তিন বছরে এমন কোনো উদ্যোগ অর্থ মন্ত্রণালয় নিতে পারেনি, যাতে প্রবৃদ্ধির উল্লম্ফন হতে পারে।


অন্যদিকে, দেশের সম্পদ ব্যবস্থাপনার জায়গাটিও দুর্বল। সম্পদ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, কারণ প্রয়োজনীয় খাতে সরকার কাঠামোগত সংস্কার করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) চলতি অর্থবছরের সামষ্টিক অর্থনীতির বিশ্লেষণ করে এক প্রতিবেদনে এ মূল্যায়ন তুলে ধরেছে। গতকাল রোববার এ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে মূল বক্তব্য দেন সংস্থার বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা বিভাগের প্রধান ফাহমিদা খাতুন, জ্যেষ্ঠ গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রমুখ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
সিপিডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে সম্প্রতি এমন এক মুদ্রানীতি করা হয়েছে, যাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ না-ও হতে পারে, আবার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার কমারও শঙ্কা রয়ে যায়। মাঝখানে ব্যক্তি খাতকে ঋণবঞ্চিত করা হলো। ফলে এরই মধ্যে শ্লথগতি দেখা দিয়েছে বিনিয়োগের ধারায়।
নীতি প্রণয়নে স্বচ্ছতা ও যোগ্যতার অভাব এবং গুণগত মানে ঘাটতির কথা উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অস্বস্তির সঙ্গে হলেও সরকার স্বীকার করেছে যে অর্থনীতিতে কালো মেঘ এসেছে। আর তাই অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধির হার ছয় থেকে সাড়ে ছয় শতাংশ অর্জন করাই কঠিন হবে বলে মনে হয়।
সিপিডির মতে, অর্থবছরের ছয় মাসে সরকারের আয়ের চেয়ে ব্যয় বাড়ার হার অনেক বেশি। সরকারের আয়-ব্যয়েও বড় ধরনের কাঠামোগত অসঙ্গতি রয়েছে। করবহির্ভূত রাজস্ব আহরণে কিছুটা উন্নতি হয়েছে ঠিক, কিন্তু রাজস্ববহির্ভূত আয়ে লক্ষণীয় অগ্রগতি নেই। ফলে আগের অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে যেখানে এক হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত ছিল, একই সময়ে সেখানে এবার ছয় হাজার ১৯৩ কোটি টাকার ঘাটতি।
এ বিষয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ছয় মাসে ব্যয় হয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এর মধ্যে উৎপাদনশীল ব্যয়ের পরিমাণ খুবই কম। অনুন্নয়ন ব্যয়ই বেড়েছে ৫০ শতাংশ। ব্যয়ের এ চরিত্র নিয়ে সংশয় থাকার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ সময়ে রাষ্ট্রীয় খাতে ভর্তুকি দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এ প্রবণতার মানেই হলো পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নিজেদের ভোগের দায় চাপিয়ে দেওয়া।’
সিপিডির মতে, শিল্প খাতে গ্যাসের ব্যবহার বাড়ছে না। আবার বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে ঠিক, পাশাপাশি চাহিদাও বেড়েছে। বিদ্যুৎ তিন হাজার মেগাওয়াট হিসাবে থাকলেও, বাস্তবে তা এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট।
বৈদেশিক ঋণ ও পদ্মা সেতু: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘ভারতের কাছ থেকে যে ১০০ কোটি ডলার সরবরাহ ঋণ নেওয়ার কথা, তার অবস্থা খুবই করুণ। বাস কেনার প্রকল্প ছাড়া অন্যগুলোর কোনো অগ্রগতি নেই। আগেই বলেছিলাম, এ ধরনের ঋণ প্রাগৈতিহাসিক ব্যাপার। দুঃখ লাগছে যে নেতিবাচক মূল্যায়নটি আজ সত্যে পরিণত হচ্ছে।’ ঋণের পরিবর্তে ভারতের কাছ থেকে এই অর্থ অনুদান হিসেবে পাওয়া যায় কি না, সরকারকে সেই চেষ্টা করার পরামর্শ দেন তিনি।
দেবপ্রিয় বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকেও যে ১০০ কোটি ডলার পাওয়ার কথা, তা গ্রহণ করাই শ্রেয়তর হবে। তবে এতে এমন কোনো শর্ত যেন না থাকে, যাতে সরকারের নীতি নির্ধারণের ক্ষমতা সংকুচিত হয়ে পড়ে।
পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বিষয়ে তিনি বলেন, খুবই ভালো কথা যে বিকল্প খোঁজা হচ্ছে। তবে বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বাধীন চার উন্নয়ন সহযোগী থেকে ঋণ নিলে গড় সুদের হার পড়বে এক শতাংশের কম। দেশের এমন আর্থিক অবস্থায় রেয়াতি সুদের পরিবর্তে বাণিজ্যিক সুদে মালয়েশিয়া বা অন্য দেশ থেকে ঋণ নিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করলে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যাবে কি না, সন্দেহ রয়েছে।
মুদ্রানীতি ও মূল্যস্ফীতি: সিপিডি বলেছে, মুদ্রানীতির লক্ষ্য হলো মূল্য পরিস্থিতি স্থিতিশীল ও প্রবৃদ্ধির ধারা বেগবান রাখা এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। অথচ শুধুই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে এবার সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি করা হলো।
দেবপ্রিয় বলেন, প্রায়ই বলা হয় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে কম। এটি মিথ্যা। ভারতের ৬ দশমিক ৫৫, পাকিস্তানের ১০ দশমিক ১, শ্রীলংকার ৩ দশমিক ৮ এবং নেপালের মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। অথচ গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ৬ শতাংশ।
তিনি বলেন, ব্যয়জনিত, চাহিদাজনিত, কাঠামোগত এবং প্রত্যাশাজনিত—এ চার কারণে মূল্যস্ফীতি হয়। অথচ বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ এড়িয়ে যাওয়া হলো। সরকারের ঋণ গ্রহণের জায়গা কিন্তু প্রশস্ত হলো এতে। বাস্তবে এমন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, যাতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে না, প্রবৃদ্ধিও ঠিক থাকবে। কিন্তু এখন যা হতে পারে বলে আশঙ্কা, মূল্যস্ফীতি তো কমবেই না, উল্টো প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে।
পুঁজিবাজার: দেবপ্রিয় বলেন, শেয়ারের দাম ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ কমেছে, বাজারে এখনো অস্থিতিশীলতা। এখনকার অস্থিতিশীলতা দিন ও ঘণ্টাভিত্তিক। বাজারে যেসব পুঁজি আসার কথা ছিল, তা আসেনি। দেবপ্রিয় বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বাজার নৈতিকতা অনুসরণ করছেন না। তাঁরা যদি প্রতিদিন কেনাবেচা করেন, তাহলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা তো করবেনই। আর প্রাথমিক বাজারের মাধ্যমে যে টাকা তোলা হয়েছে, তা শিল্প সম্পদে পরিণত হওয়ার কথা। প্রশ্ন রাখেন দেবপ্রিয়, ‘তা কি হয়েছে?’
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করে পুঁজিবাজারে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এটি দরকার এই কারণে যে ভবিষ্যতে যাতে আর কেউ অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বমূলক ভূমিকা না পালনের উদাহরণ দিতে গিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, ‘পদ্মা সেতুর বিষয়টি দেখার কথা ছিল অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের। আবার সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের বিষয়টি দেখার কথা অর্থ মন্ত্রণালয়ের। অথচ অন্যরা এতে হস্তক্ষেপ করে।’
এক প্রশ্নের জবাবে সিপিডির এই প্রতিবেদনকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ইতিবাচকভাবে দেখবেন বলেই আশা করেন দেবপ্রিয়।

No comments

Powered by Blogger.