ধর্ম-মানবসম্পদ উন্নয়নে ইমামদের ভূমিকা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ইসলাম মানবসম্পদ উন্নয়ন নিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ধারণার ব্যাখ্যা করে, যেখানে নৈতিকতা ও আর্থসামাজিক অগ্রগতির ওপর বিশেষভাবে তাগিদ দেওয়া হয়। ইসলামে মানবশক্তির আধ্যাত্মিক উন্নয়নের সঙ্গে পূত-পবিত্রতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং এটা মানবচরিত্রকে পরিবেষ্টন করে আছে,


যা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে অর্জন করে মানুষকে সামগ্রিক পরিপূর্ণতা দান করে। ফলে একজন নীতিমান মানুষ সামাজিক কল্যাণ ও মানবিক উন্নয়নে সমর্থ হয় এবং ইহকাল ও পরকালে সাফল্য লাভ করে।
সর্বপ্রথম নবী হজরত আদম (আ.) থেকে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত প্রত্যেক নবী-রাসুল স্ব স্ব জাতিকে মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) নির্দেশ প্রদান করেছেন, ‘তোমাদের সন্তানদের উত্তমরূপে জ্ঞান দান করো, কেননা তারা তোমাদের পরবর্তী যুগের জন্য সৃষ্ট।’ (মুসলিম)
মানবসম্পদ উন্নয়নের ওপর একটি ধর্মপ্রাণ জাতি তথা দেশের সার্বিক উন্নয়ন নির্ভর করে। মানবজাতির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হচ্ছে শিশুরা। তাদের যদি পরিকল্পিত পরিবারে ধর্মীয় অনুশাসন ও আদর্শ শিক্ষায় গড়ে তোলা যায়, তাহলে ভবিষ্যৎ পৃথিবী হবে সুন্দর। তাদের ভালোভাবে প্রতিপালিত করা পিতামাতা ও অভিভাবকদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের মাধ্যমেই মানবসম্পদ উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি হয়। তাই মানবসন্তানের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য প্রতিটি শিশুর শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য তাদের পর্যাপ্ত মানসম্মত জীবনযাপনের অধিকার সংরক্ষণ করা উচিত। এ সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সন্তানদের (শিশুদের) স্নেহ করো, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো এবং সদাচরণ ও শিষ্টাচার শিক্ষা দাও।’ (তিরমিজি)
মানবজাতি এমন এক বিরাট সম্পদ, যা সঠিকভাবে কার্যকর করা হলে প্রতিষ্ঠান তথা দেশে ও জাতির প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। আর মানবসম্পদের যথাযথ ব্যবহার করা না হলে অন্য সব উপাদান কার্যকর থাকলেও উন্নয়ন-প্রক্রিয়া দারুণভাবে ব্যাহত হয়। সুতরাং মানবসম্পদ উন্নয়নে দেশের পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ, আলেম সমাজ, ধর্মীয় নেতা বা মসজিদের ইমামদের ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। অবক্ষয়মুক্ত সমাজ, ধর্মীয় অনুশাসন ও মানুষকে মানবসম্পদে রূপান্তর করতে সমাজে ইমামদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। মানুষের নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন ও সংশোধনের মাধ্যমে একটি উন্নত নৈতিকতাপূর্ণ আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালানো ইমামদের দৈনন্দিন কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত। মানুষ চেষ্টার মাধ্যমে নিজের ভাগ্যের উন্নয়ন ও পরিবর্তন ঘটায় এবং আল্লাহ তাআলা তার জীবনের সফলতার পথ সুগম করে দেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে।’ (সূরা: আর-রাদ, আয়াত-১১)
ইমাম-খতিবেরা জনগণকে এ শিক্ষা দেবেন যে চেষ্টা ও সাধনা মানবজাতির উন্নতির চাবিকাঠি। পৃথিবীর বহু জাতি-গোষ্ঠী জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ক্ষুধা, দারিদ্র্য বিমোচন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে যে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে, এর মূলে রয়েছে চেষ্টা ও পরিশ্রম। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘আর এই যে, মানুষ তা-ই পায়, যা সে চেষ্টা করে।’ (সূরা আন-নাজ্ম, আয়াত-৩৯)
সমাজের ধর্মীয় নেতারা জনগণকে ঐক্য, সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, স্বদেশপ্রেম, মানবপ্রেম, সমাজকল্যাণ সর্বোপরি মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা দেবেন এবং নিজেদের মেধা, শ্রম ও মসজিদের অবকাঠামোগত সুবিধা কাজে লাগিয়ে সহজেই জাতীয় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে সমাজ থেকে বেকারত্ব দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, স্বাবলম্বন তথা ধর্মপ্রাণ মানুষকে কর্মপ্রেমিক করে তুলতে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান হবেন। ইমামদের সম্পৃক্ত করে নিরক্ষরতা দূরীকরণ, মাদকাসক্তি প্রতিরোধ, নারী ও শিশু নির্যাতন রোধ, পরিবেশ সংরক্ষণ, পশুপালন এবং মৎস্য চাষসহ জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উত্তরণ ঘটানো যেতে পারে। দেশের আড়াই লক্ষাধিক মসজিদের পাঁচ লাখের বেশি ইমাম-মোয়াজ্জিন যদি পরিকল্পিত পন্থায় অগ্রসর হন, তাহলে তাঁরা মসজিদের আওতাধীন ধর্মপ্রাণ মানুষকে অনৈতিক বিষয়াদি সম্পর্কে সজাগ-সচেতন থাকার ব্যাপারে অবহিত করে আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারেন।
ইসলাম মানবসম্পদ উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে, অথচ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে মানবসম্পদ উন্নয়নের বিষয়টি অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে। সমকালীন প্রেক্ষাপটে জাতীয় উন্নয়নের জন্য অত্যাবশ্যক হচ্ছে মানবসম্পদের উন্নয়ন। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বিশ্বায়নের যুগে সততা ও মেধাই হচ্ছে যোগ্যতার অন্যতম মাপকাঠি। তাই বর্তমান তথ্য ও প্রযুক্তির জগতে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা, লাগসই প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও গবেষণার মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় মানবজাতিকে এগিয়ে যেতে হবে। বর্তমান বিশ্বে প্রতিযোগিতায় দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে অবদান রাখতে হবে। জ্ঞানভিত্তিক মুসলিম সমাজ গঠনের জন্য শিক্ষিত মানবসম্পদের কোনো বিকল্প নেই। উন্নত চিন্তা, কর্মসাধনা, মেধা ও মননশীলতার বিকাশ ঘটিয়ে তারাই দেশকে উন্নতির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাসী এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদায় উন্নত করবেন।’ (সূরা আল-মুজাদালা, আয়াত-১১)
মসজিদের ইমামদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত করে তাঁদের সমাজের আর্থসামাজিক উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করে ধর্মীয় নেতৃত্বের বিকাশ সাধন করা যেতে পারে। মুসলিম সমাজের আধ্যাত্মিক নেতৃবৃন্দ ও সৎ মানুষগুলোকে মানবসম্পদ উন্নয়নমূলক কাজে সম্পৃক্তকরণ ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে যদি এলাকার অগ্রগতির কাজে লাগানো যায়, তাহলে সমাজের চেহারা আমূল পরিবর্তন হতে পারে এবং পারিবারিক কল্যাণ তথা দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি সুনিশ্চিত করা যাবে বলে আশা করা যায়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dৎ.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.