কূটনীতি-‘সন্ধিক্ষণে’ কৃষ্ণার ঢাকা সফর by রাহীদ এজাজ

পূর্বনির্ধারিতই ছিল ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণার ঢাকা সফর। কিন্তু বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সাম্প্রতিক এক মন্তব্যের পর কৃষ্ণার সফর ঘিরে খুব স্বাভাবিকভাবেই বাড়তি মনোযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। ‘বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর প্রতি ২৫ শতাংশ লোকের সমর্থন রয়েছে, যারা প্রচণ্ড ভারতবিদ্বেষী এবং


আইএসআইয়ের প্রভাবান্বিত’—মনমোহনের এ মন্তব্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফর নিয়েও তৈরি হয় শঙ্কা। অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই ৪ জুলাই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা করে, ‘আগামী ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর দুই দিনের সফরে বাংলাদেশে আসছেন মনমোহন সিং।’ অথচ দুই দেশের পক্ষ থেকে বেশ কিছুদিন ধরেই বলা হচ্ছিল, এস এম কৃষ্ণার সফরের সময় ঘোষিত হবে মনমোহনের সফরসূচি। যা-ই হোক, মনমোহনের সফরের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ৬ থেকে ৮ জুলাই ঢাকা ঘুরে গেছেন এস এম কৃষ্ণা। দিল্লি যাওয়ার আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পাশে রেখে জানিয়ে গেছেন, সেপ্টেম্বরে হাসিনা-মনমোহন বৈঠকে সই হবে সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি ও তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি।
দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক শেষে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানের যে আভাস দেওয়া হয়েছে, তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়ার দুই নিকট প্রতিবেশীর গত চার দশকের সম্পর্কে যে বিষয়গুলো নিয়ে টানাপোড়েন চলছে—তিস্তা ও সীমান্ত বিরোধ এর অন্যতম। এ দুটি বিষয়ের সমাধান পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস সুদৃঢ় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে সন্দেহ নেই। দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধান দুই দেশকে ‘সন্ধিক্ষণ’ পেরিয়ে নতুন যুগে পা রাখতে উৎসাহিত করবে। তবে আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে প্রস্তাবিত চুক্তিগুলোতে বাংলাদেশের স্বার্থ পুরোপুরি সুরক্ষিত হয়েছে কি না, তা দেখার জন্য।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা শুনিয়ে গেলেও ট্রানজিটসহ বেশ কিছু প্রসঙ্গে তাঁর দেশের অবস্থান খুব স্পষ্ট করেননি। তেমনি যে বিষয়গুলো নিয়ে জোরালোভাবে তাঁর সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন ছিল, আমাদের নেতৃত্ব তা যথাযথভাবে করতে পেরেছেন কি না, সে ব্যাপারেও সংশয়মুক্ত হওয়া যাচ্ছে না।
শুরুতেই আসা যাক মনমোহনের বক্তব্যটি নিয়ে। গত ২৯ জুন দিল্লিতে কয়েকজন পত্রিকা সম্পাদকের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় তিনি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ওপরের মন্তব্যটি করেন, যা প্রথমে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হলেও এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির পর তা প্রত্যাহার করা হয়। খুব সংগত কারণেই এ দেশের জনগণের প্রত্যাশা ছিল, এ বিষয়ে কৃষ্ণা তাঁর দেশের অবস্থান প্রসঙ্গে কিছু বলবেন। কিন্তু সম্পাদকদের বৈঠক কিংবা যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি শুধু এটাই বলেছেন, বাংলাদেশের প্রতি বিশেষ সহমর্মিতা রয়েছে। এমনকি গত শুক্রবার বিআইআইএসএসের অনুষ্ঠানে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব পোষণ করে যে অংশটি, সে ব্যাপারে তাঁর সরকারের কী করার আছে। এ প্রসঙ্গে তিনি মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সব সময় সুসম্পর্ক বজায় রাখার অভিপ্রায়ের কথা উল্লেখ করেন। ‘যে দেশের অভ্যুদয়ে আমাদের ভূমিকা আছে, সে দেশের বিরুদ্ধে কিছু করা কি আমাদের সম্ভব? তাই আসুন, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই।’
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে তেমন আলোচনা হয়নি বলে আমরা জানতে পেরেছি। এমনকি প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে এস এম কৃষ্ণা সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনিও বিষয়টি তুলেছেন বলে শুনিনি।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে ট্রানজিট অন্যতম প্রধান আলোচিত বিষয়। গত বছরের জানুয়ারি মাসে হাসিনা-মনমোহন শীর্ষ বৈঠকের পর থেকেই ট্রানজিটের সিদ্ধান্ত হয়। এর পর থেকেই ট্রানজিটের আলোচনায় কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছে মাশুল আদায়ের প্রসঙ্গটি। কারণ, ট্রানজিটের মাশুল আদায় করা হলে ভারতের সঙ্গে অসম বাণিজ্য-বৈষম্য কমবে, সরকারের পক্ষ থেকে শুরুতে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। অথচ গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধে এসেই সরকারের একটি অংশ বিনা মাশুলে ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার পক্ষে মত দেয়। এমন পরিস্থিতিতে এবার কৃষ্ণাকে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হলে তিনি শুধু বলে গেছেন, ট্রানজিটের চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে। এতে দুই পক্ষের লাভ হবে। কিন্তু তিনি স্পষ্ট করে বলেননি, ভারত মাশুল দেবে কি না, দিলেও কী হারে দেবে। অথচ একই সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেন, বাংলাদেশ যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে চায়। অর্থাৎ এই অঞ্চলের সব কটি দেশকে ট্রানজিট দেওয়া হবে। এই অবস্থান থেকেই ভারতের সঙ্গে সমন্বিতভাবে ট্রানজিট চুক্তি করা হবে। তাঁর বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট, বাংলাদেশ ব্যাপক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ভারতের সঙ্গে ট্রানজিটের জন্য একটি রূপরেখা চুক্তিতে আগ্রহী। অথচ ভারত মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপনে আলাদাভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি করতে চায়। এ মুহূর্তে দেশের দুই সমুদ্রবন্দর নিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে একটি চুক্তির খসড়া বাংলাদেশকে দেওয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দুই ভিন্ন অবস্থান থেকে দুই দেশ কীভাবে সমাধানে পৌঁছায়, তার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে। তবে বাংলাদেশকে ট্রানজিটের মাশুল আদায়ের পাশাপাশি সেবা দেওয়ার বিষয়ে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে ওঠার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। ট্রানজিট নিয়ে প্রধান বিরোধী দল রাজনীতির মাঠে সোচ্চার থাকলেও এস এম কৃষ্ণার সফরে বিষয়টি নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করেনি। বিরোধীদলীয় নেত্রী শুধু তাঁকে জানিয়েছেন, ভারতসহ সব দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সব চুক্তি জনসমক্ষে আনা উচিত। এ ব্যাপারে কৃষ্ণার পরামর্শ, বাংলাদেশের জনগণের ও রাজনৈতিক দলগুলোর এ দাবি তোলা উচিত।
এক শ কোটি ডলারের ঋণচুক্তির ঘোষণার পর থেকেই এ বিষয়ে আলোচনায় গুরুত্ব দিয়ে আসছে ভারত। কিন্তু এর বাস্তবায়নে আমরা দীর্ঘসূত্রতাও লক্ষ করেছি। গত বছরের আগস্টে দুই দেশের অর্থমন্ত্রীদের উপস্থিতিতে চুক্তিটি সই হয়। এরপর প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও চুক্তির আওতায় সব কিছু চূড়ান্ত হয়নি। বাংলাদেশের দেওয়া প্রকল্পগুলোর বেশ কয়েকটি ভারত অনুমোদন করেছে। এর মধ্যে একটি প্রকল্পের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে বলা যায়, অন্যান্য বিষয়ের মতো এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সময় নেওয়া হলে তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর, দুই দেশ দাবি করছে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিশেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিভিন্ন পর্যায়ের নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠান তাদের দাবিকে সমর্থন করে। পাশাপাশি আমরা এটাও লক্ষ করেছি, অতীতের মতো না হলেও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা এখনো রয়ে গেছে; বিশেষ করে, দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক শেষে যৌথ ইশতেহারে যেসব সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়েছিল, তার অনেকগুলোই বাস্তবায়িত হয়নি। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের পর ৭ জুলাই যে চুক্তিগুলো সই হয়েছে, তা মূলত চুক্তি বাস্তবায়নের দলিল। এর মধ্যে বিনিয়োগ সুরক্ষা চুক্তি সই হয়েছিল ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। অন্যদিকে ভুটানের সঙ্গে ট্রাক চলাচলের সিদ্ধান্তটি হয়েছিল গত জানুয়ারিতে। কাজেই দুই দেশ যখন বারবার সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় পৌঁছে দেওয়ার দাবি করে, দ্রুত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেও তাদের মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়। বাংলাদেশের মানুষ আশা করে, মনমোহনের সফরের আগেই যৌথ ইশতেহারের অধিকাংশ সিদ্ধান্ত আলোর মুখ দেখবে। নতুন যুগে পদার্পণ করবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক।
রাহীদ এজাজ: সাংবাদিক।
ৎaheed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.