সময়চিত্র-পঞ্চদশ সংশোধনী: অগণতান্ত্রিক এবং বিপজ্জনক by আসিফ নজরুল

বাংলাদেশে সংবিধান সংশোধন করা হয় সরকারি দলের স্বার্থে। কখনো তা ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে বা কখনো পরের নির্বাচনটিও জেতার পথ তৈরি করতে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে দোহাই দেওয়া হয় জনগণের, জনস্বার্থের, জনকল্যাণের।


যে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্রের প্রায় কবর রচিত হয়েছিল তাকেও বলা হয়েছিল ‘শোষিতের গণতন্ত্র’। এই সংশোধনী জারি করতে বঙ্গবন্ধুর কষ্ট হয়েছিল এবং সম্ভবত দ্বিধাও তাঁর কম ছিল না। সংসদে সেদিন দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আজকের এই সংশোধন কম দুঃখে করি নাই।’ দুঃখের কথা আরও কয়েকবার তিনি ভাষণে বলেছেন, সারা জীবন বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে কেন তিনি একদল কায়েম করলেন, তার কৈফিয়তও দিয়েছেন।
আমাদের দুই নেত্রীর এত দুঃখবোধ বা কৈফিয়ত নেই। তাঁরা সংবিধান সংশোধন করেন বীরদর্পে, সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের বলে বলীয়ান হয়ে। খালেদা জিয়া সংবিধান সংশোধন করে পছন্দমতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার করতে চেয়েছিলেন। শেখ হাসিনা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারই বাদ দিয়ে দিয়েছেন। তবে তিনি আরও বহু কিছু করেছেন এই সংশোধনীর মাধ্যমে। তিনি জিয়া ও এরশাদের রাজনীতি কিছুটা দখল করেছেন এবং আরও যা ভয়াবহ, তিনি বাকশালকেও কিছুটা ধারণ করেছেন। অভূতপূর্ব পঞ্চদশ সংশোধনী তাই হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের প্রতিটি আমলের বিস্বাদ জগাখিচুড়ি।

২.
জগাখিচুড়ি সংশোধন নিয়ে আপত্তি তুলেছে আওয়ামী লীগের বহু রাজনৈতিক মিত্র। তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য হয়তো সংবিধান সংশোধনী নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, আরেকবার নির্বাচনে জিতলে আওয়ামী লীগ ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাবে। এই নির্জলা স্বীকারোক্তি প্রমাণ করে যে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আসলে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যায়নি।
আমার ধারণা, বাহাত্তরের বিধানে ফিরে যাওয়া বলতে সৈয়দ আশরাফও পুরোপুরি ফিরে যাওয়ার কথা বোঝাননি। তিনি নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ আবার জিতলে নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা-সম্পর্কিত ১৯৭২ সালের বিধানগুলো সংবিধানে অবিকলভাবে ফিরিয়ে আনার কথা বোঝাননি! মাসদার হোসেন মামলার রায় আশ্চর্যজনকভাবে উপেক্ষা করে উচ্চ আদালতই এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি, বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজও নিম্নকণ্ঠ এ বিষয়ে। কাজেই এ নিয়ে আওয়ামী লীগের মাথাব্যথা থাকার কথা নয়। জোরেশোরে সমালোচনা হচ্ছে বরং পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম একসঙ্গে সংবিধানে রাখা নিয়ে। সৈয়দ আশরাফ হয়তো তার ইঙ্গিতই দিয়েছেন। আবার নির্বাচনে জিতলে হয়তো আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করে দেবে, বিসমিল্লাহ তুলে দেবে। হয়তো ধর্মভিত্তিক রাজনীতিও নিষিদ্ধ করবে। কিন্তু এ জন্য প্রয়োজন আবারও দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়। আমার ধারণা, সেই চিন্তাও কিছুটা কাজ করেছে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করার ক্ষেত্রে।

৩.
পঞ্চদশ সংশোধনীর ধর্মসংক্রান্ত বৈপরীত্য আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে তেমন সুবিধা না-ও দিতে পারে। রাষ্ট্রধর্ম আর বিসমিল্লাহ থাকলেও এই সংশোধনীর পর সংবিধানে আর ‘আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা আর বিশ্বাস’ নেই। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো এ নিয়ে কথা বলবেই। আওয়ামী লীগের বোঝার কথা যে আগামী নির্বাচনে শুধু বিসমিল্লাহ আর রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে আল্লাহকে বাদ দেওয়ার প্রচারণার যথেষ্ট জবাব দেওয়ার সম্ভাবনা তাদের নেই। জেতার সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য তাই আরও বহু পরিবর্তন তারা এনেছে সংবিধানে। এর একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলুপ্তি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করার সুযোগ আওয়ামী লীগের জন্য তৈরি হয় উচ্চ আদালতের বিতর্কিত রায়ে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে বহু বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত, হাইকোর্টের মামলায় বৈধ হিসেবে বিবেচিত, আপিল বিভাগে একজন বাদে বাকি সব অ্যামিকাস কিউরি কর্তৃক সমর্থিত। এই সরকার অব্যাহত রাখার পক্ষে সংবিধান সংশোধন কমিটির আলোচনায় আওয়ামী লীগসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল, আইনজ্ঞ ও নাগরিক সমাজ একমত হয়েছিল। পুরো আলোচনা যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শুধু কিছু সংস্কারকে ঘিরে, তখন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের সভাপতিত্বে তাঁর অবসরে যাওয়ার প্রাক্কালে তড়িঘড়ি করে এই মামলার রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশ প্রদান করা হয়। সংক্ষিপ্ত আদেশের প্রথম লাইনে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখন থেকে অবৈধ। আবার দ্বিতীয় লাইনে দেশ ও জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে ভবিষ্যতে আরও দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে বলে অভিমত দেওয়া হয়। তৃতীয় লাইনে ভবিষ্যৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারে বিচারপতিদের না রাখার নির্দেশনা প্রদান করা হয় সংসদকে।
সরল বিশ্বাসে এই আদেশ অবলম্বনে আগামী দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা হলে কোনো আইনি জটিলতা হতো না, বর্তমান রাজনৈতিক সহিংসতারও আকস্মিক উদ্ভব ঘটত না। জনগণ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য বরং সেটি মঙ্গলজনক হতো। আওয়ামী লীগ তা করেনি। তারা আদালতের আদেশের শুধু প্রথম লাইন সামনে রেখে তাদেরই অধীনে নির্বাচন করার লক্ষ্যে রায়ের পর রকেট গতিতে সংবিধান সংশোধন করে ফেলেছে। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে কারচুপি ও জালিয়াতির দুঃখজনক নিরবচ্ছিন্ন ঐতিহ্য আমাদের রয়েছে এবং আছে (যেমন—এই সরকারের আমলের বিতর্কিত ভোলা উপনির্বাচন)। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিবন্ধকতাগুলোও (যেমন—প্রধান দুটো রাজনৈতিক দলের মধ্যে তীব্র অবিশ্বাস, দলীয়করণ প্রশাসন, পক্ষপাতপূর্ণ ও সীমিত ক্ষমতার নির্বাচন কমিশন) এখনো রয়েছে এবং অলৌকিক কিছু না ঘটলে থেকে যাবে। এই বাস্তবতায় পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান সংযোজন আগামী নির্বাচনে কারচুপি করে জেতার অপচেষ্টা হিসেবে ভাবলে বিরোধী দলকে দোষ দেওয়া যাবে না। এই পরিবর্তন অনাকাঙ্ক্ষিত হরতালকে ডেকে এনেছে, নজিরবিহীনভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত ও পুলিশি বর্বরতার মাধ্যমে বিরোধী দলকে দমন ও নিপীড়নের তাণ্ডবকেও ডেকে এনেছে। রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা ইতিমধ্যেই বিঘ্নিত হতে শুরু করেছে।
এ ছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনীতে আরও কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা বিরোধী দলকে আরও নিপীড়ন ও দুর্বল করার লক্ষ্যে ব্যবহার করা যাবে। সবচেয়ে যা আশঙ্কাজনক, এসব বিধান দেশে মুক্তচিন্তা, বহু মতের চর্চা, বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রুদ্ধ করার সুযোগও সৃষ্টি করেছে।

৪.
আমার দৃষ্টিতে পঞ্চদশ সংশোধনীর সবচেয়ে বিপজ্জনক বিধান সংবিধানের ৭ক অনুচ্ছেদের কিছু অংশ। এর একটি অংশে অসাংবিধানিক পন্থায় সংবিধান বা এর কোনো অনুচ্ছেদ বাতিল ও স্থগিতকরণকে রাষ্ট্রদোহের অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এ নিয়ে কারও আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু ৭ক-এর আর একটি অংশে ‘এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে’ তাকেও রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে আখ্যায়িত করে সর্বোচ্চ দণ্ডের বিধান করা হয়েছে। বাকশালীয় চেতনার এই বিধানকে একদলীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং বিরোধী দল ও ভিন্নমত দমন করার কাজে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। এটি সংবিধানের যেকোনো অনুচ্ছেদ নিয়ে মুক্ত ও মননশীল চিন্তা, বাকস্বাধীনতা এমনকি বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনার পথ রুদ্ধ করতে পারে। এই বিধান অনুসারে পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে যতগুলো সমালোচনামূলক নিবন্ধ ছাপা হয়েছে বা গণমাধ্যমে আলোচনা হয়েছে, সবকিছুর জন্য লেখক, বক্তা ও সম্পাদকদের গ্রেপ্তার ও কারাবাসের উদ্যোগ পর্যন্ত সরকার নিতে পারে! পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বা দক্ষিণ এশিয়ার কোনো রাষ্ট্রেও এমন গণবিরোধী বিধান সংবিধানে নেই।
পঞ্চদশ সংশোধনীতে ভবিষ্যৎ সংসদগুলোর ক্ষমতা পর্যন্ত মারাত্মকভাবে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। এর ৭খ অনুচ্ছেদে সংবিধানের মৌলিক নীতিমালাসহ অন্তত অর্ধশত অনুচ্ছেদকে মৌলিক কাঠামো হিসেবে আখ্যায়িত করে তা সংশোধনের অযোগ্য বলে বিধান করা হয়েছে। আমার প্রশ্ন, সংবিধানের ৮(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে যে বিষয়গুলো আদালতের মাধ্যমে বলবৎ করার অধিকার পর্যন্ত নাগরিকদের নেই, তা কীভাবে মৌলিক কাঠামো হতে পারে? আর সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ঘোষণা করার অধিকার সংসদকে কে দিয়েছে? এই ক্ষমতা এমনকি উচ্চ আদালত প্রয়োগ করতে পারেন কি না, এ নিয়েই বিশ্বব্যাপী বিতর্ক রয়েছে। ৭খ সত্যি হলে সৈয়দ আশরাফের কথামতো ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ কীভাবে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফেরত যাবে? ভবিষ্যতে কোনো সংসদ রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করতে চাইলে, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের অধিকার মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে তা করারও তো কোনো সুযোগ থাকবে না। ৭খ থাকলে সংবিধান নিয়ে বর্তমান সংসদের প্রায় সব চিন্তাচেতনাই বাংলাদেশের সব সংসদকে অনন্তকাল পর্যন্ত চূড়ান্ত ও অলঙ্ঘনীয়ভাবে মেনে নিতে হবে!
পঞ্চদশ সংশোধনী ভবিষ্যতে অতিগুরুত্বপূর্ণ সংবিধান সংশোধনীতে নাগরিকদের অংশগ্রহণও বাতিল করেছে। সারা বিশ্বে যখন সংবিধান সংশোধনী বিষয়ে গণভোট গ্রহণের রেওয়াজ ক্রমাগতভাবে বাড়ছে, তখন বাংলাদেশে গণভোটের সুযোগ কেড়ে নেওয়ার যৌক্তিকতা কী? গণভোটে অন্যতম অনীহ দেশ বলে পরিচিত ব্রিটেনে মাত্র দুই মাস আগে নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রশ্নে গণভোট হয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকার বহু দেশে গত ২০ বছরে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে ভবিষ্যৎ সংসদ ও সাধারণ জনগণের ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কেড়ে নেওয়ার এসব প্রচেষ্টা একদলীয় দর্শনের প্রকাশ ছাড়া আর কী হতে পারে?

৫.
পঞ্চদশ সংশোধনীতে ভালো কিছু নেই, তা নয়। এতে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, মহিলাদের (হওয়া উচিত ছিল নারীদের) সর্বক্ষেত্রে সুযোগের সমতা নিশ্চিতকরণ এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। ৭০ অনুচ্ছেদকে ১৯৭২ সালের বিধানে নিয়ে গিয়ে সাংসদদের অন্তত ভোটাভুটি বর্জনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীতে উন্নতি কেবল এটুকু। এই অগ্রগতি ম্লান হয়ে গেছে সংশোধনীটিতে থাকা চিন্তাচেতনায় সামন্তবাদী, একদলীয় এবং অগণতান্ত্রিক বহু বিধানের কারণে।
বাংলাদেশের মানুষ এ ধরনের বিধান অতীতে মেনে নেয়নি, ভবিষ্যতেও নেওয়ার কারণ নেই। দুঃখ হচ্ছে, সংবিধানের অবিরত পশ্চাদযাত্রা ঠেকাতে হয়তো আরও বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে সাধারণ মানুষকে। অর্থনৈতিক উন্নতির অপার সম্ভাবনার এই দেশকে এভাবেই বঞ্চিত করে চলেছে অপরাজনীতির বিষবাষ্প।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.