দিল্লির চিঠি-বিহারের অগ্রযাত্রা কি থমকে গেল? by কুলদীপ নায়ার

শেষবার যখন বিহারে গিয়েছিলাম, তখন ১৫ বছর ধরে লালু প্রসাদ যাদবের অপশাসনের অবসানে পরিবর্তনের সুবাতাস টের পেয়েছিলাম। রাজ্যে আইন ও শৃঙ্খলা ফিরে এসেছিল। জনগণ সন্ধ্যায় বা রাতে নির্বিঘ্নে ঘরের বাইরে যেতে পারতেন—লালুর পান্ডাদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা না করেই।


রোগীদের কেন্দ্র করে হাসপাতালগুলোতে চঞ্চলতা ছিল—চিকিৎসক যেমন পাওয়া যেত, তেমনি জায়গামতো ওষুধও পাওয়া যেত। স্কুলে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ও নানা কর্মকাণ্ডে প্রাণচাঞ্চল্য বিরাজ করত। প্রাইভেট পড়ানোর বদলে শিক্ষকেরা শ্রেণীকক্ষে পাঠদানে মনোনিবেশ করতেন।
সে সময় মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার প্রায় জাদুকরি পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলেন। গত কয়েক দশক রাজ্যে যে জিনিসের বড় অভাব ছিল, সেই আস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে এনেছিলেন। রাজ্যের প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে ভারতের গড় প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশ ছোঁয়া সম্ভব হয়েছিল। বিহারের শ্রমজীবী মানুষের জীবন বাঁচানোর তাগিদে ফসলের মৌসুমে পাঞ্জাব ও অন্যান্য রাজ্যে চলে যাওয়া বন্ধ হয়েছিল। গ্রামীণ কর্মসংস্থান পরিকল্পনাকে নিতীশ বিচক্ষণভাবে ব্যবহার করে বছরে ১০০ দিন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। এর মাধ্যমে কাজের সন্ধানে শ্রমজীবী মানুষের অন্য রাজ্যে চলে যাওয়া ঠেকাতে সক্ষম হন।
ভেবেছিলাম, অবশেষে বিহারবাসী বুঝি এমন নেতার খোঁজ পেল, যিনি অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক পশ্চাৎপদতা থেকে তাদের টেনে তুলবেন। কিন্তু এ কথা কেবল তাঁর প্রথম মেয়াদের বেলাতেই খাটে। কয়েক দিন আগে পাটনায় থাকার সময় বিষয়টি উপলব্ধি করলাম। নিতীশের দ্বিতীয় মেয়াদে পরিস্থিতির স্পষ্ট অবনতি ঘটেছে। সবখানে কর্তব্যকর্মে শিথিলতা চলে এসেছে। আইন ও শৃঙ্খলাযন্ত্রে অবক্ষয়। বহু অপরাধী সরকারি সুরক্ষা পাচ্ছে। সম্প্রতি গোপালগঞ্জ কারাগারে এক চিকিৎসকের মৃত্যু এবং আরারিয়া জেলায় পুলিশের গুলিতে চার ব্যক্তি নিহত হওয়ার ঘটনায় মানুষ ক্রুদ্ধ হয়েছে।
নিতীশের ভাবমূর্তিতে সত্যিকারে কালিমা লেপন করেছে ফরবেসগঞ্জের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। প্রথম মেয়াদে কোনো দাঙ্গা ঘটেনি। কোনো সম্প্রদায় যেন কোনো ধরনের বৈষম্যের শিকার না হয়, কিংবা কোনো অস্থিরতা সৃষ্টি না হয়, তার দেখভাল নিতীশ নিজেই করেছেন। রাজ্যের ভোটারদের ১২ শতাংশ মুসলমান। সাম্প্রতিক দাঙ্গাগুলো তাদের নিরাপত্তাহীনতার বোধ তীব্রতর করেছে। সবচেয়ে বড় দাঙ্গাটি সংঘটিত হয়েছিল ভাগলপুরে, কংগ্রেসের শাসনামলে। এখন দুই দশকেরও বেশি কাল ধরে কংগ্রেস ক্ষমতার বাইরে রয়েছে। দলটি যে জায়গা হারিয়েছিল, তা শিগগিরই ফিরে পাওয়ার কোনো লক্ষণ আমি দেখছি না।
বিহার হলো সেই রাজ্য, যেখানে পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন গান্ধীবাদী জয় প্রকাশ নারায়ণ। সেই আন্দোলনের তোড়ে ১৯৭৭ সালে উত্তর ভারত থেকে কংগ্রেস আগাগোড়া উচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। জয় প্রকাশ নারায়ণের জন্মস্থান কদম কুয়ান দেখে আমি হতাশ হয়েছিলাম। অতিদ্রুত বস্তিতে পরিণত হচ্ছে জায়গাটি। বর্ধনশীল জনসংখ্যা আর সে সঙ্গে পয়ো, পানি ও যোগাযোগস্বল্পতা যুক্ত হলে বেশির ভাগ নগরের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটা স্বাভাবিক।
জয় প্রকাশের সেই আন্দোলনের ফসল নিতীশ। যাঁরা ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি শাসনের সময় ছয় মাস বা ততোধিক কাল আটক ছিলেন, তাঁদের সবার জন্য পাঁচ হাজার রুপি পেনশন দেওয়ার বিধান তিনি করেছিলেন। তথাপি, জয় প্রকাশের সচিব সচ্চিদানন্দের পরিবার অসন্তুষ্ট এ কারণে যে তাদের ন্যায্য দাবি অস্বীকার করার জন্য নিতীশ অতি তৎপর ছিলেন। আমি বুঝে উঠতে পারি না, রাজ্যের বিধানসভায় জয় প্রকাশের ছবি প্রদর্শন করতে নিতীশ কেন অনিচ্ছুক।
অনেক সময় বলা হয়ে থাকে, নিতীশ হয়তো একদিন প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসবেন। সে পথে হাঁটতে গিয়ে তিনি এতটাই সতর্ক যে বিজেপিকে একেবারেই অসন্তুষ্ট করতে চান না। বিজেপি তাঁর জোটগত মিত্র। কখনো-সখনো তিনি তাদের বিরুদ্ধে প্রতীকী অবস্থান নেন—গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে একই মঞ্চে বক্তৃতা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিজেপির সুশীল কুমার মোদিকে তিনি সাদরে নিজের উপমুখ্যমন্ত্রী করে রেখেছেন।
আমার সর্বশেষ সফরের পুরো সময় নানাজনের কাছ থেকে শুনেছি, প্রথম মেয়াদে নিতীশ কতটা অভিনব ও সৃজনশীল কায়দায় রাজ্য শাসন করেছিলেন। পঞ্চায়েতে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ কিংবা স্কুল বা কলেজগামী মেয়েদের মধ্যে সাইকেল বিতরণের মতো কর্মসূচি তিনি নিয়েছিলেন। এবার তাঁর কী হলো? দ্বিতীয় মেয়াদের দুই বছর তো পেরিয়ে গেল। নতুন কোনো ভাবনা, নতুন কোনো পদক্ষেপ দেখা গেল না। মনে হচ্ছে, নিতীশ বুঝি ফুরিয়ে গেছেন। তাঁর নিজের জন্য কিংবা তাঁর সরকারের জন্য এ তো অশুভ সংবাদ। ভারতের চার বিমারু (BIMARU), অর্থাৎ রুগ্ণ রাজ্যের অন্যতম বিহার। বাকি তিনটি রাজ্য হলো—মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান ও উত্তর প্রদেশ। এ কথা অনস্বীকার্য যে অন্য তিনটি রাজ্যের চেয়ে বিহারকে এখনো এগিয়ে রেখেছেন নিতীশ। বিহার উন্নয়নের পথে জোর কদমে আগায়নি, এমনও নয়। তবে নিতীশের পক্ষে যা করা সম্ভব ছিল, সেটা তিনি পারেননি। এবার হয়তো তাঁর দুর্বলতার প্রধান জায়গা আমলাতন্ত্র। তাঁর প্রচণ্ড নির্ভরতা তৈরি হয়েছে আমলাদের ওপর। আর আমলাতন্ত্র তাঁর আস্থার মর্যাদা রাখেনি। তারা নিজস্ব পথে চলেছে। কিন্তু কী আশ্চর্য, তিনি এদের লাগাম টেনে ধরতে কিছু করছেন বলে মনে হচ্ছে না। কেন এমন ঘটছে? আত্মবিশ্বাসের অভাবে, নাকি রাজনৈতিক সমর্থনের ঘাটতি থাকায়?
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.