নিত্যজাতম্‌-আজও ১২ মার্চ, তবে... by মহসীন হাবিব

মহাত্মা গান্ধীর কর্ম, সংগ্রাম ও জীবনকে উদাহরণ হিসেবে টানাটানি করি না বিশেষ দুটি কারণে। একটি হলো, রাজনৈতিক নিবন্ধ লিখতে গিয়ে লাখোবার নিবন্ধকাররা গান্ধী থেকে উদাহরণ দিয়েছেন এবং এখনো দিয়ে থাকেন। প্রথমত, হয়তো সে কারণে, নিবন্ধ পাঠকের কাছে গান্ধী থেকে উদ্ধৃতি ক্লেশে ঠেকতে পারে।


দ্বিতীয়ত, মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক চেতনা থেকে আমাদের রাজনীতি এত দূরে অবস্থান করছে যে গান্ধীর আদর্শ-চিন্তা এখানকার রাজনীতির সঙ্গে তুলনা করা খানিকটা অন্ধকে হাতি প্রদর্শনের শামিল, যা উলুবনে মুক্তা ছড়ানো ছাড়া আর কিছু নয়। তথাপি গান্ধী আমাদের রাজনীতির পূর্বসূরি। তিনি বারবার উদারতা ও মহত্ত্বের প্রশ্নে প্রাসঙ্গিক হয়ে দেখা দেন। রাজনীতিবিদরা না হোন, এ দেশে এখনো তো কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা মহাত্মা গান্ধীকে ব্যক্তিজীবনে ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সাধন করার ইচ্ছা রাখেন। তাই গান্ধীর উদাহরণ চলে আসে। অন্যদিকে এ দেশের শিক্ষা-বিদ্যাবিমুখ রাজনীতিতে গান্ধী বিস্মৃত হলেও বিশ্ব রাজনীতি তাঁর জীবন ও কর্মকে আদর্শের মানদণ্ড হিসেবে সমুন্নত রাখতে লড়াই করে যাচ্ছে। বিশ্ব রাজনীতি বলতে সেই দেশগুলো যাদের ধমক খেয়ে, পরামর্শ শুনে আমাদের রাজনীতির ব্যাপারিদের প্রতিটি পা ফেলতে হয়। যাদের হুকুম ছাড়া সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক চর্চার এ দেশের গাছের পাতাও নড়ছে না। সুতরাং গান্ধী প্রতিটি মুহূর্তে এখনো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। যেমন_২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা (এখন এই সময়ে আমরা বুঝতে পারছি না, কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মগুলোর কাছে কিন্তু এই বারাক ওবামা একজন আব্রাহাম লিঙ্কন হয়ে থাকবেন) ভার্জিনিয়ার ওয়েকফিল্ড হাই স্কুল পরিদর্শনে যান। পরিদর্শনকালে লিলি নামের এক শিক্ষার্থী ওবামার কাছে জানতে চায়, মি. প্রেসিডেন্ট, মৃত অথবা জীবিত কোন ব্যক্তির সঙ্গে আপনি ডিনার করতে চান? প্রশ্নের উত্তরে ওবামা স্মিত হেসে বলেন, 'জীবিত অথবা মৃতের তালিকাটি অনেক বড়। তবে এর মধ্যে আমি খাবার খেতাম মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে। যদিও খাবারের পরিমাণটা হতো খুবই কম। কারণ, তিনি খেতেন খুব কম।' এরপর ওবামা গম্ভীর হয়ে বলেন, তিনি হলেন সেই ব্যক্তি, যার দ্বারা আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি। ড. মার্টিন লুথার কিং গান্ধীর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।'
শুধু ওবামা কিংবা মার্টিন লুথার কিং নন, পৃথিবীর ইতিহাসের আরেক জীবন্ত কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলাও গান্ধীর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এখন গান্ধীর ছবি নিয়ে, গান্ধীর বাণী লেখা ব্যানার নিয়ে মানুষ শান্তির পক্ষে মিছিল করতে নামে। অথচ চুপসে যাই যখন ভাবি গান্ধীর বাহ্যিক উত্তরাধিকার আমরা, এই দেশ।
সে দিনটিও ছিল ১২ মার্চ। ১৯৩০ সালের আজকের দিন। মহাত্মা গান্ধী ৭৮ জন অনুসারী নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের ১৮৮২ সালের লবণ আইনের (সল্ট অ্যাক্ট) প্রতিবাদে আহমেদাবাদের সবরমতি আশ্রম থেকে রোডমার্চ করে ২৪০ মাইল দূরের আরব সাগর উপকূলের ড্যান্ডি গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিলেন। (সারা বিশ্বে এই ড্যান্ডি গ্রাম এক ইতিহাস হয়ে আছে, তবে আমরা বাংলাদেশের জনগণ এই ড্যান্ডির উদাহরণ ভুলে গেছি। আমরা ভিন্ন এক কলঙ্কিত ড্যান্ডির গল্প জানি।) তিনি কাউকে ভাড়া করে আনেননি, অথবা কাউকে হুমকি-ধমকি করেননি। বরং এই প্রতিবাদের আগে ভাইসরয় লর্ড আরউইনকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, Dear friend, I hold the British rule to be a curse, I do not intend to harm a single Englishman or to any legitimate interest he may have in India....My ambition is nothing less than to bring round the English people through non-violence to recognize the injustice they have done to India. I do not intend to be offensive to your people.
গান্ধী যখন সবরমতি আশ্রমে ভাষণ দিয়েছিলেন তখন সেখানে সেই সময়ে ৬০ হাজার মানুষের সমাগম হয়েছিল বলে পরবর্তী সময়ে আমেরিকার এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি যাত্রাকালে অনেকগুলো পথসভা করেছিলেন। তখন ছিল ধুলোর সময়। ভারতের নারী-পুরুষরা তাঁর যাত্রাপথে কলসি ও বালতি ভরে পানি এনে ঢেলে দিয়ে পথ ধুলোমুক্ত করেছিল। ২৪০ মাইলের পথে হাজার হাজার নারী-পুরুষ ফুল ছিটিয়ে রেখেছিল। জনগণের এ স্বতঃস্ফূর্ত ভক্তির প্রধান কারণ ছিল, তিনি যে আইন ভঙ্গ করতে ড্যান্ডির পথে যাত্রা করেছিলেন, সে আইন ভঙ্গ করা ভারতবর্ষের মানুষের জীবন-মরণ লড়াইয়ের অন্যতম প্রয়োজনীয়তা হয়ে দেখা দিয়েছিল। ৬ এপ্রিল তিনি ড্যান্ডি পৌঁছে ছিলেন। ঘটনাক্রমে গান্ধী গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এই লবণ সত্যাগ্রহই ভারতের স্বাধীনতার দাবিকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিল। এই সত্যাগ্রহই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। সেই পরম্পরাতেই গান্ধী পৃথিবীর সর্বকালের সর্বসেরা মহাত্মা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন।
৮২ বছর পর তিন খণ্ডে বিভক্ত গান্ধীর ভারতের একটি অংশ বাংলাদেশে আজও এসেছে ১২ মার্চ। বিএনপি নামক একটি রাজনৈতিক দল 'চলো চলো ঢাকা চলো' নামের একটি রোডমার্চের আয়োজন করেছে। না, এ 'ঢাকা চলো' আন্দোলনে কেউ ফুল ছিটিয়ে রাখবে না; কেউ নিজের আগ্রহে রাস্তার ধুলো সরাতে আসবে না। বরং সরকার এ পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে রেখেছে। সাধারণ মানুষ একটি আতঙ্ক নিয়ে ঘরে বসে টেলিভিশনে সহিংসতা দেখার অপেক্ষা করবে আজ। আর সেই সুবাদে সরকার কয়েক দিন ধরে যে নগ্ন আচরণ করে আসছে, তা অব্যাহত রাখবে। এই লেখা তৈরির সময় পর্যন্ত অন্তত তাই অনুমিত হচ্ছে।
একটি গণতান্ত্রিক দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের দায়িত্ব পালনকালে বিরোধী দল সমাবেশ করবে, মহাসমাবেশ করবে, সরকারের বিভিন্ন কাজের প্রতিবাদ করবে_এটি গণতন্ত্রেরই আশীর্বাদ। কিন্তু কী হীন, বেহায়া আচরণ আমরা দুই পক্ষের কাছ থেকে দেখছি! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন হোটেলগুলোতে যেন কোনো নতুন বোর্ডার না রাখা হয়! সে অনুযায়ী কয়েক দিন ধরে হোটেলে কোনো লোক ব্যক্তিগত প্রয়োজনেও উঠতে পারছে না। বাইরে থেকে দূরপাল্লার গাড়ি ব্যবহার করে যেন সমাবেশে লোক আসতে না পারে সে জন্য সরকারই একটি অঘোষিত ধর্মঘটের অয়োজন করেছে। নৌপথে, কোনো কোনো রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর একজন এপিএস সচিবালয়ে বৈঠক করে হুমকি দিয়ে এসেছেন, সরকারি কর্মকর্তা কারা কারা ১২ মার্চ অফিসে না থাকে, তাদের তালিকা করবেন। অথচ এই বৈঠকেই ৭ মার্চ সরকারি দল আওয়ামী লীগের এক গণসমাবেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অফিসের কাজকর্ম ফেলে রেখে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এ কোন অরাজকতার মধ্যে আমরা বাস করছি! এর নাম কি গণতন্ত্র!
শুধু সরকারই নয়, গণতান্ত্রিক আচরণ বিরোধী দলের মধ্যেও পুরোপুরি অনুপস্থিত। একটি সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি, বলতে গেলে একটি দিনের জন্য সংসদে গিয়ে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা-প্রয়োজনের কথা বলল না। তিনটি বছর পার হয়ে গেল। দেশের গণমাধ্যম এবং দেশ ও বিদেশের লবি বহু পরামর্শ দিল সংসদে যাওয়ার। কিন্তু বিরোধী দলের হাবভাবে মনে হচ্ছে, শুধু ক্ষমতা ফিরে পাওয়া ছাড়া আর কোনো গণতন্ত্রে তারা রাজি নয়। এ আন্দোলনের সঙ্গে জনতা কী করে যোগ দেবে?
সেটা যাই হোক, প্রধান বিরোধী দল তো আর একেবারে জনবিচ্ছিন্ন নয়। তাদেরও তো কমবেশি সমর্থন আছে। তারা কয়েক লাখ লোক ঢাকায় এনে সমাবেশ করলে এত শক্তিশালী ম্যান্ডেট পাওয়া সরকার ভয় পাচ্ছে কেন? ইকি সরকার ভিন্নমত সহ্য করতে রাজি নয়? মুয়াম্মার গাদ্দাফি অথবা বাশার আল আসাদের মতো বাংলাদেশের সরকার কেন ভাববে যে তাদের কোনো বিরোধিতা থাকবে না?
গবেষকরা বলেন, তিরিশের দশকে যখন পূর্ণ স্বরাজ আন্দোলন জমে উঠছিল না, তখন মহাত্মা গান্ধী জনগণের ভাষা ব্যবহারের জন্য লবণ সত্যাগ্রহ বেছে নিয়েছিলেন। গান্ধীর সেই ১২ মার্চের সঙ্গে আজকের ১২ মার্চের পার্থক্য এখানেই। বিএনপি গত তিন বছরে দলের ভাষা ছাড়া জনগণের ভাষায় কথা বলতে শেখেনি বা চেষ্টা করেনি। দূরদৃষ্টি দিয়ে আওয়ামী লীগের বোঝা উচিত ছিল, কয়েক লাখ লোক সমাগম করে বিএনপি শুধু আত্মতৃপ্তিই লাভ করত। আরব বসন্তের বাতাস এখানে বইয়ে দিতে পারত না। অতএব স্বৈরশাসকের মতো আচরণ করা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের চরম অন্যায় হলো। এ আচরণে দেশ ডিজিটাল বাংলাদেশের দিকে না এগিয়ে খানিকটা পিছিয়ে গেল বলেই আমার ধারণা।
লেখক : সাংবাদিক
mohshin.habib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.