কালের পুরাণ-আমরা কি এই গণতন্ত্রই চেয়েছিলাম? by সোহরাব হাসান

বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, প্রতি চার বছর পর লিপইয়ার বা অধিবর্ষ আসে, সে বছরটি ফেব্রুয়ারি মাস ২৯ দিনে গণনা করা হয়। চলতি বছরটি অধিবর্ষ। ২০০৪ সালটিও ছিল অধিবর্ষ। এই দুটি বছরের মধ্যে একটি আশ্চর্য মিল লক্ষ করা যায়। দুটি বছরই বাংলাদেশে রাজনৈতিক দুর্যোগ নেমে এসেছে। মহাদুর্যোগ।


বিরোধী দলের ১২ মার্চের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সমগ্র দেশ প্রায় অচল হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বিরোধী দলের কর্মসূচি ছিল ‘চলো চলো ঢাকা চলো’। আর সরকার কর্মসূচি নিয়েছে ‘রুখো রুখো ঢাকা রুখো’। অর্থাৎ, ঢাকায় কাউকে আসতে দেওয়া হবে না। ঘোষিত ও অঘোষিতভাবে সরকার ঢাকামুখী অধিকাংশ রুটের বাস ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। সব প্রবেশপথে বসানো হয়েছে চেকপোস্ট। প্রথম আলো গতকাল প্রধান শিরোনাম করেছে ‘ঢাকায় ঢুকতে মানা’। সরকারের পুলিশ বাহিনী ইতিমধ্যে শত শত লোককে গ্রেপ্তার করেছে, যাদের একাংশ বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মী হলেও সিংহভাগ নিরীহ ও সাধারণ মানুষ। গরিব মানুষ। খেটে খাওয়া মানুষ। এর পাশাপাশি ঢাকার বিভিন্ন হোটেলে ‘অতিথি’ রাখতেও বারণ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঘরে-বাইরে মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে—কী হবে আজ ১২ মার্চ? কী হবে তারপর?
এই ঘটনার সঙ্গে আট বছর আগে ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসের ঘটনাবলি মিলিয়ে নেওয়া যায়। তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। আর বিরোধী দলে ছিল আওয়ামী লীগ। এখন ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ আর বিরোধী দলে বিএনপি।
২১ এপ্রিল আওয়ামী লীগ হাওয়া ভবন ঘেরাওয়ের কর্মসূচি নিয়েছিল। এ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ৩২ ঘণ্টায় দুই হাজার ৫০০ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল বিএনপি সরকার। ২১ এপ্রিলের প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম ছিল ‘আওয়ামী লীগের হাওয়া ভবন ঘেরাও কর্মসূচি আজ, কঠোর অবস্থানে সরকার।’ প্রধান শিরোনামের নিচে তিন কলামে আরেকটি প্রতিবেদন ছিল গ্রেপ্তার-সংক্রান্ত। এতে বলা হয়, ‘অভিযানটি ঘেরাও কর্মসূচি নামে চললেও মূলত এটি পরিচালিত হয় বাস ও রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট এবং বস্তিতে। সোমবার বিকেল চারটা থেকে রাজধানীতে আগত প্রায় প্রত্যেক যাত্রীকে প্রতিটি স্টেশনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।’
পরদিন ২২ এপ্রিলের পত্রিকার খবরে বলা হয়, ‘বনানী ও গুলিস্তান এলাকায় অঘোষিত কার্ফু, চলাচল বন্ধ, হাওয়া ভবন কর্মসূচিতে বাধা, লাঠিচার্জ, গ্রেপ্তার।’ এরপরের শিরোনামটি ছিল: ‘কঠোর নিরাপত্তার ঘেরাটোপে উৎসবমুখর হাওয়া ভবন’। আর সেই হাওয়া ভবনের পাশের মাঠে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান ক্রিকেট খেলছিলেন, যার ছবি পরদিন সব কাগজে ফলাও করে ছাপা হয়েছে। ২৩ এপ্রিল প্রথম আলোয় দ্বিতীয় প্রধান শিরোনাম ছিল ‘রাজধানীতে ছিল অভিযান, চার দিনে পাঁচ হাজার আটক, গ্রেপ্তারকৃতদের বেশির ভাগ গরিব, আদালতে উপচে পড়া ভিড়’। ২৪ এপ্রিল থেকে আওয়ামী লীগ তিন দিনের গণ-অনাস্থা কর্মসূচি পালন করে। ঢাকায় লাগাতার অবস্থানের উদ্যোগ। ২৪ এপ্রিলের কাগজে দেখা যায়, গণগ্রেপ্তারে সারা দেশে পাঁচ দিনে সাত হাজারের বেশি।
২৮ ও ২৯ এপ্রিল আওয়ামী লীগ হরতাল পালন করে। হরতালের পর তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সরকারের পতনযাত্রা শুরু হয়েছে।’ অন্যদিকে বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া তারেক রহমানকে পাশে রেখে আরেক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতে আরও বড় ষড়যন্ত্র করতে পারে, সজাগ থাকতে হবে।’
পাঠক, এখন ২০১২ সালের মধ্য মার্চের ঘটনার সঙ্গে ২০০৪ সালের শেষ এপ্রিলের ঘটনা মিলিয়ে নিন। কলাকুশলী প্রায় অভিন্ন। কিন্তু তাঁদের ভূমিকা ভিন্ন। সে সময়ে যাঁরা বিরোধী দলে ছিলেন তাঁরা যা যা বলেছেন, এখনকার বিরোধী দল প্রায় একই কথা বলে চলেছে। আবার সে সময়ে সরকার যা যা করেছে, এখনকার সরকারও তা-ই করছে। তখন বিরোধী দল গণতন্ত্র রক্ষার শপথ নিয়েছিল। এখনকার বিরোধী দল গণতন্ত্র রক্ষা করতে চাইছে। তখনকার বিরোধী দল মধ্যবর্তী নির্বাচন চেয়েছিল। এখনকার বিরোধী দলও মধ্যবর্তী নির্বাচন চাইছে। সে সময় বিএনপি সরকার বিরোধী দলের আন্দোলনের মধ্যে ষড়যন্ত্র খুঁজে পেয়েছিল। এখন আওয়ামী লীগ ওরফে মহাজোট সরকার বিরোধী দলের আন্দোলনের মধ্যে ষড়যন্ত্র খুঁজছে। তখনকার পুলিশপ্রধান যে ভাষায় ও যে সুরে কথা বলছেন, এখনকার পুলিশপ্রধানও সেই ভাষায় কথা বলছেন। তখন লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগ, এখন বিএনপি।
এই যে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে হানাহানি-খেয়োখেয়ি, কর্মসূচি-পাল্টা কর্মসূচি—এর আদৌ প্রয়োজন ছিল কি না? সরকারের দায়িত্ব কি রাস্তাঘাট বন্ধ করে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ানো? আর বিরোধী দলের কাজ কি মাসের পর মাস সমাবেশ করা? মিছিল ও লংমার্চ করা? একটি লংমার্চ ও সমাবেশে যে টাকা খরচ হয়, তা দিয়ে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করা যেত। আবার সরকার বিরোধী দলকে ঠেঙাতে যে অর্থ ব্যয় করে, তা দিয়ে অন্তত জেলা সদরে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা যেত। মসনদে থাকার এবং মসনদে যাওয়ার জন্য এই লড়াই আর কত দিন? এর সঙ্গে দেশের ১৬ কোটি মানুষের কী সম্পর্ক? সরকার ও বিরোধী দলের ক্ষমতার লড়াইয়ের অসহায় শিকার কেন হবে সাধারণ মানুষ? কেন তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ব্যাহত হবে? কেন তাদের রুটিরুজির পথ বন্ধ হয়ে যাবে? কেন একজন নাগরিক বাড়ি থেকে বের হয়ে বাস বা লঞ্চ স্টেশনে গিয়ে শুনবে, ঢাকায় যাওয়ার সব যানবাহন বন্ধ? সরকার কি একবারও ভেবেছে এর ফলে গুরুতর অসুস্থ রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে পারেন? বেকার যুবকটি ইন্টারভিউ দিতে না পেরে চাকরির শেষ সুযোগটি হারাতে পারেন। একজন দিনমজুর কাজে যেতে না পারলে পুরো পরিবারটিকে উপোস থাকতে হয়। গণতান্ত্রিক সরকারের এ কেমন গণবিরোধী নীতি!
আওয়ামী লীগ দেশের যা কিছু মন্দ, যা কিছু দুর্গতির জন্য বিএনপিকে দায়ী করে। তাদের নীতি ও আদর্শকে ‘হারাম’ মনে করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ বিএনপির পথই অনুসরণ করে চলেছে। বিএনপি সরকার আওয়ামী লীগের মিছিলে হামলা করত, আওয়ামী লীগ সরকারও বিএনপির মিছিলে হামলা করছে। পুলিশ না পারলে দলীয় ক্যাডারদের লেলিয়ে দিচ্ছে। এ লেখাটি যখন তৈরি করছি তখন খবর পেলাম, সদরঘাটে লঞ্চযাত্রীদের ওপর শ্রমিক লীগের পান্ডারা হামলা চালিয়েছে। এই লঞ্চযাত্রীরা কি সবাই বিএনপি-জামায়াতের কর্মী? যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধী? মন্ত্রী ও নেতারা উসকানি দিচ্ছেন, আর কর্মীরা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। এসব কিসের আলামত?
১২ মার্চ বিএনপির মহাসমাবেশটি নির্বিঘ্নে হয়ে গেলে একটি নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটত না, ক্ষমতাসীন দলেরও কোনো ক্ষতি হতো না। কিন্তু মহাসমাবেশে বাধা দিয়ে ক্ষমাতাসীন দল নিজের দেউলিয়াত্ব দেশবাসীর কাছে প্রকাশ করল। ১২ তারিখের আগে ৭ মার্চ গণমিছিল করে, ১১ মার্চ মানববন্ধন করে নিজেদের শক্তি দেখিয়েছে। ১৪ মার্চও তারা আরও শক্তি দেখাতে পারে। কিন্তু বিএনপির সমাবেশ ও নেতা-কর্মীদের চলাচলে বাধা দেবে কেন? সরকার পুলিশ দিয়ে, বিজিবি দিয়ে, র‌্যাব দিয়ে, সেনাবাহিনী দিয়ে বিরোধী দলের সমাবেশ পণ্ড করে দিতে পারে, কিন্তু জনগণের সমর্থন বাড়াতে পারবে না। সে জন্য জনগণের কল্যাণে তাকে কাজ করে দেখাতে হবে।
২০০৪ সালে বিএনপি সরকার ভয় পেয়ে আওয়ামী লীগ তথা সাধারণ মানুষের ওপর দমননীতি শুরু করেছিল। আজ আওয়ামী লীগও একই কাজ করছে। একই পথ অনুসরণ করছে। তাহলে গণতন্ত্রের সিপাহশালাদের সঙ্গে মৌলবাদের সহযোগীদের পার্থক্য থাকলকোথায়? ২০০৮ সালের নির্বাচনে জনগণ বিএনপি-জামায়াতকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তিন বছর পর এসে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারই সেই প্রত্যাখ্যাত বিএনপি-জামায়াতকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে।
আওয়ামী লীগের অতি উৎসাহী ও বাকচতুর নেতা ও মন্ত্রীদের বলব, দেয়ালের ভাষা পড়ুন। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিন।
আমরা হলফ করে বলতে পারি, সরকার এই চণ্ডনীতি চালাতে থালে, আওয়ামী লীগ নেতারা, মন্ত্রীদের আস্ফাালন বন্ধ না হলে বিএনপির ক্ষমতায় আসার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হবে না। শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও জনগণ তার সমুচিত জবাব দিয়ে দেবে।
এই যে বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি বন্ধ করা, গণগ্রেপ্তার চালানো আর আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় এবং সাধারণ মানুষের হয়রানি করা হচ্ছে, এরই নাম কি গণতন্ত্র?
বিএনপি-জামায়াত সরকারের গণবিরোধী নীতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কর্মকান্ডের প্রেক্ষাপটে প্রয়াত লেখক হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন, ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম।’
আজ স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বলে দাবিদার আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের নামে পুলিশতন্ত্র চালাচ্ছে, অন্যের মত প্রকাশের অধিকার খর্ব করছে, জনজীবনে অসহনীয় দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে। এসব দেখে যে প্রশ্নটি ওঠে তা হলো, ‘আমরা কি এই গণতন্ত্রই চেয়েছিলাম’?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.