চরাচর-কবিরাজের কবজায় বনরুই

সুন্দরবন ও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের কয়েকটি গভীর জঙ্গলে বনরুইয়ের বিস্তৃতি। বেশ কয়েক বছর আগেও উত্তরবঙ্গে এ প্রাণীটি দেখা যেত। বর্তমানে এটি বিলুপ্ত প্রাণীগুলোর কাতারে শামিল হয়েছে। দেখতে সরীসৃপ গোত্রের মতো মনে হলেও বনরুই আসলে স্তন্যপায়ী প্রাণী। প্রকৃতির আশ্চর্য সৃষ্টির মধ্যে অন্যতম একটি প্রাণী হচ্ছে বনরুই। গোটা শরীর ওদের রুই মাছের মতো বড় বড় আঁশে আবৃত। আঁশের বর্ণ মেটে হলদেটে এবং গায়ের গন্ধও ঠিক মাছের


মতোই। অনেকটাই গুইসাপ আকৃতির দেখতে। এদের মাথা সরু ও খাটো। বনরুইয়ের দাঁত নেই, তবে বেশ লম্বা একটা জিভ রয়েছে। জিভ দিয়ে এরা দৈনন্দিন খাবার সংগ্রহসহ সব কর্ম সাধন করে। এদের সামনের পায়ের চেয়ে পেছনের পা দুটো লম্বা। এরা নিশাচর প্রাণী। এদের দৃষ্টিশক্তি একেবারেই ক্ষীণ। খাবার সংগ্রহ করে গন্ধ শুঁকে শুঁকে। দিনে বিশ্রাম নিয়ে রাতে বের হয় খাবারের সন্ধানে। বনরুই রাতের অন্ধকারে তীক্ষ্ন নখ দিয়ে উইঢিবি উপড়ে ফেলে আঠালো জিভের সাহায্যে উইপোকা শিকার করে। পিঁপড়া আর উইপোকা এদের প্রধান খাবার। অত্যন্ত নিরীহ গোত্রের এসব প্রাণী মানুষের কোনো ক্ষতি করে না, বরং মানুষকে খুব ভয় পায়। শুধু মানুষকেই নয়, যেকোনো ধরনের মাংসাশী প্রাণী দেখলে এরা ভয়ে গুটিসুটি মেরে ফুটবলের মতো গোল হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে। যেন কেউ সহজে আক্রমণ করতে না পারে। অন্য প্রাণীরা এমতাবস্থায় ধোঁকা খেয়ে পগারপার হলেও মানুষের হাতে ধৃত হয় এ সময় বেশি। অর্থলোভী পিশাচদল ওদের পাকড়াও করে চালান দেয় কবিরাজদের কাছে। আর কবিরাজরা ওদের কেটেকুটে নানা উপায়ে ওষুধ বানিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে যৌনরোগ এবং বাতব্যথার অব্যর্থ ওষুধ বলে চালিয়ে দেয়। শুধু কবিরাজরাই নয়, বিভিন্ন হারবাল কম্পানিও রীতিমতো বনরুই দ্বারা ওষুধ বানিয়ে অর্থ উপার্জন করছে। বলতে গেলে প্রায় প্রকাশ্যে এ নিধনযজ্ঞে অংশ নিচ্ছে এ অপচিকিৎসক দল। রাস্তার পাশে বনরুইয়ের চামড়াটা ফেলে ওষুধ নামক অপ ওষুধ বিক্রি করছে তারা। প্রকাশ্য দিবালোকে এমনটি ঘটার অন্যতম কারণ আমাদের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনের দুর্বলতা। ১৯৭৪ সালে প্রণীত বিদ্যমান বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে শাস্তির বিধান সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ২০০০ টাকা জরিমানা। আর খুব বেশি হলে ছয় মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। তাও অবশ্য ব্যক্তিবিশেষে। তবে সুখবরটি হচ্ছে, বন্য প্রাণী সংরক্ষণের নতুন আইনের ২০১০ সালের খসড়াটি মতামতের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। প্রস্তাবে বাঘ হত্যা করলে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা জরিমানা ও ১২ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া অন্য সব বন্য প্রাণী শিকার করলে অথবা আইন লঙ্ঘনকারীকে সর্বনিম্ন ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা এবং চার থেকে সাত বছর কারাদণ্ডের কথা বলা আছে। প্রস্তাবটি আইনে পরিণত হলে শুধু বনরুই-ই নয়, অনেক বিপন্ন বন্য প্রাণী রক্ষা পাবে। এ ক্ষেত্রে আইন হলেই চলবে না, তার প্রয়োগও হতে হবে যথাযথ। তা না হলে আগামী দশকের মধ্যেই অনেক বন্য প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে আমাদের পঙ্গু পরিবেশটি।
আলম শাইন

No comments

Powered by Blogger.