ধর্মান্ধতা ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে আপসহীন by রবীন আহসান

তিনি কোনো সরকারের পক্ষে মতলববাজ বুদ্ধিজীবী হয়ে রাষ্ট্রীয় কোনো সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেননি। লিখে চলেছেন মেহনতি মানুষের পক্ষে, পাশে আছেন তাদের দৈনন্দিন আন্দোলনের সংগ্রামে। ৮০তম জন্মদিনে বাংলাদেশসহ বিশ্বের নিপীড়িত মেহনতি মানুষের পক্ষে লিখে চলা বদরুদ্দীন উমরকে রক্তিম শুভেচ্ছা। শত বছর তিনি যেন লিখতে পারেন_ তার আপসহীন কলম মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের


সঙ্গে থাকবেন তিনি। এই প্রত্যাশা আমাদের সবার আজ আশিতে পা দিলেন আমাদের সময়ের কিংবদন্তি লেখক, ইতিহাসবিদ, মার্কসবাদী আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ কমরেড বদরুদ্দীন উমর। পূর্ববাংলার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগ্রামের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য নাম বদরুদ্দীন উমর। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি ছিলেন প্রথম সারির একজন। আমরা কখনও তার মুখে শুনিনি সেই রক্ত ঝরানো ইতিহাসের সঙ্গে একাত্ম থাকা মানুষটির আত্মপ্রচার। ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস তিন খণ্ডে প্রকাশিত হওয়ার আগেই তিনি পাকিস্তানি আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময় লিখেছিলেন 'সংস্কৃতির সংকট', 'সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা', 'সাম্প্রদায়িকতা'-এর মতো অসাধারণ সব গ্রন্থ। উমরের এসব বইয়ের প্রভাব সেই সময় পূর্ববাংলায় বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে ষাট ও সত্তরের দশকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় পাকিস্তানি সামরিক সরকারের সঙ্গে তার লেখালেখি নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল সাম্প্রদায়িক শিক্ষক সে সময় পাকিস্তান সরকারের সেবায় নিয়োজিত ছিল। উমর সেই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন ১৯৬৮ সালে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময়ও তিনি ছিলেন সোচ্চার ও আন্দোলনের রাজপথের কর্মী। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর সঙ্গে রাজনৈতিক সংগ্রাম ও আন্দোলনের জন্য ঘুরে বেরিয়েছেন গ্রামের পর গ্রাম।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করা সেই সময়ের 'বাবুদের' জনগণের কাতারে থাকার ইতিহাস বিরল। তিনি ব্যতিক্রম এবং জীবনের সবধরনের প্রতিষ্ঠার মোহ ত্যাগ করে বদরুদ্দীন উমর নেমে এসেছিলেন পূর্ববাংলার শ্রমিকশ্রেণী ও মেহনতি মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামে। ব্রিটিশ ইংরেজ বাবুদের উচ্চশিক্ষায় উমর কী হতে পারতেন, কী হতে পারেননি; এ নিয়ে আমাদের কোনো আফসোস নেই। বদরুদ্দীন উমর শেষ পর্যন্ত মেহনতি মানুষের বন্ধু হয়েছেন_ এই তো বড় পাওয়া আমাদের জন্য। আমরা যারা বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর জন্মেছি তারা দেখছি বদরুদ্দীন উমরের লেখনী শক্তি, রাজনীতি ও সমাজ বিশ্লেষণের নতুন ধারা। ১৯৯০ সালে এরশাদের সামরিক শাসন ও পরবর্তী সময় জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যোক্তাদের একজন বদরুদ্দীন উমরের বিশ্লেষণধর্মী রাজনৈতিক প্রবন্ধ আমাদের তার সঙ্গে পরিচিত হতে এবং তার পাশে লড়াইয়ে বন্ধু হতে সহায়তা করেছে।
৮০ বছরে পা দেওয়া আমাদের প্রিয় লেখক বদরুদ্দীন উমর এখনও নিয়মিত সংবাদপত্রে লিখে চলেছেন তার রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ। বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর সরকার ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের চিন্তাচেতনার বিরুদ্ধে বদরুদ্দীন উমরের লেখা তরুণ প্রজন্মকে বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রচলিত সমাজ সম্পর্কে সজাগ করে তোলে। ১৯৬৯-এ 'গণশক্তি' পত্রিকার সম্পাদক থাকাকালীন বদরুদ্দীন উমর পাকিস্তানি সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে সমানে লিখতেন। সেই লেখনী তার আজও একই রকম আছে। স্বাধীন বাংলাদেশের ৪০ বছরেও উমর কোনো প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার গ্রহণ করেননি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বদরুদ্দীন উমর সম্পাদনা করেন 'সংস্কৃতি' পত্রিকা। এই সময়কালে সংস্কৃতি পত্রিকায় বাংলাদেশের খ্যাতিমান কবি, গল্পকার, চলচ্চিত্রকার, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই লিখতেন। তাদের মধ্যে কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বেশ কয়েকটি প্রবন্ধের সঙ্গে আমরা পরিচিত হই বদরুদ্দীন উমর সম্পাদিত সংস্কৃতি পত্রিকার মাধ্যমে। এ দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে তার সম্পাদিত 'সংস্কৃতি'র কথা আমাদের স্বীকার করতে হবে।
তিনি কোনো সরকারের পক্ষে মতলববাজ বুদ্ধিজীবী হয়ে রাষ্ট্রীয় কোনো সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেননি। লিখে চলেছেন মেহনতি মানুষের পক্ষে, পাশে আছেন তাদের দৈনন্দিন আন্দোলনের সংগ্রামে। ৮০তম জন্মদিনে বাংলাদেশসহ বিশ্বের নিপীড়িত মেহনতি মানুষের পক্ষে লিখে চলা বদরুদ্দীন উমরকে রক্তিম শুভেচ্ছা। শত বছর তিনি যেন লিখতে পারেন_ তার আপসহীন কলম মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের সঙ্গে থাকবেন তিনি। এই প্রত্যাশা আমাদের সবার।

রবীন আহসান : ছড়াকার, প্রকাশক শ্রাবণ প্রকাশনী

No comments

Powered by Blogger.