প্রবীণকল্যাণ-বৃদ্ধাশ্রম: শেষ বয়সের ঠিকানা by এ বি এম আবদুল্লাহ

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এখন অনেকেই ওল্ড হোম বা বৃদ্ধদের জন্য আবাসিক ভবনে এসে আশ্রয় নেন। কেউ হয়তো স্বাধীনভাবে থাকার জন্য স্বেচ্ছায় চলে যান বৃদ্ধাশ্রমে, কেউ বা নিতান্ত বাধ্য হয়েই এ ভাগ্য বরণ করে নেন। ওল্ড হোম নিয়ে আজকের লেখা শুরু করতে চাই একটি বিখ্যাত জনপ্রিয় গানের কলি দিয়ে— ‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার। নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি সবচেয়ে কম দামি


ছিলাম একমাত্র আমি।
ছেলের আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম
আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।’
বৃদ্ধনিবাস ধারণাটি পশ্চিমের। বিগত শতকের শুরু থেকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, আধুনিক, গতিশীল জীবনযাত্রার উত্তরণ এবং একান্নবর্তী পরিবারভিত্তিক সমাজব্যবস্থার ক্ষয়ের ফল এসব বৃদ্ধাশ্রম। পশ্চিমা বিশ্বের পুঁজিবাদীব্যবস্থা অনুৎপাদনশীল মানুষকে রাখতে চায় মূল কাঠামোর বাইরে, অন্যদিকে ন্যায়ভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থার দায় সারতে চায় সহজেই। এর সঙ্গে আছে তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। তাই শেষ জীবনের আনন্দাশ্রম হিসেবে বৃদ্ধাশ্রমই হলো তাদের কাছে সুন্দর স্বাভাবিক ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা এখন তাদের সংস্কৃতির অংশ। সন্তানের যখন বয়স ১৮ পার হয়, তখন থেকেই তাঁর স্বাধীন, স্বতন্ত্র জীবনের শুরু হয়। আবার কর্মজীবন শেষে বৃদ্ধ বয়সের অবসরে সবাই নিজের মতো করেই স্বাধীনভাবে শেষ দিনগুলো কাটাতে চান, সন্তানের গলগ্রহ হয়ে থাকতে চান না। তাই অনেকে নিজের মতো একাই থাকেন, কেউ বা ওল্ড হোমে অন্য বৃদ্ধদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করেন। জীবনের শুরুতে স্কুলে যাওয়ার মতোই শেষ জীবনের বৃদ্ধাশ্রমে থাকা তাঁদের কাছে খুব স্বাভাবিক।
আজকাল আমাদের দেশেও বৃদ্ধদের জন্য এমন নিবাস গড়ে তোলা হচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমে যা স্বাভাবিক জীবনযাত্রার উপকরণ, আমাদের দেশে তা ভিন্ন। এখানে ব্যক্তির চেয়ে পরিবারের গুরুত্ব বেশি। একান্নবর্তী ব্যবস্থা এখন খুব একটা না দেখা গেলেও অন্তত পিতা-মাতাকে নিজের পরিবারভুক্ত হিসেবেই গণ্য করা হয়। ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়ে পরস্পরের সান্নিধ্যের শান্তিটুকুর মূল্য অনেক বেশি। তাই সন্তান স্বাবলম্বী হলেই পিতা-মাতাকে ত্যাগ করে একা থাকবে তা প্রত্যাশিত নয়। এখানে সন্তান সাবালক হলেই পিতা-মাতার দায়িত্ব শেষ হয় না, তেমনি বৃদ্ধ পিতা-মাতার দেখাশোনা করার সামাজিক দায়ভার সন্তানের ওপরই বর্তায়। তাই পশ্চিমের ওল্ড হোম আমাদের জীবনধারায় অনুপস্থিত থাকাটাই কাম্য ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এর বিপরীতটাই দেখা যাচ্ছে।
বৃদ্ধাশ্রম আমাদের দেশে সংস্কৃতির অংশ নয়, বরং কিছুটা প্রয়োজন এবং অনেকটাই মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রকাশ। আমাদের এখানে যাঁরা বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন, তাঁদের বেশির ভাগই যে স্বেচ্ছায় থাকেন, তা নয়। অনেকেই সন্তানের অবহেলা যা অযত্নের কারণে, কখনো কখনো দুর্ব্যবহারের শিকার হয়ে আশ্রয় নেন এসব নিবাসে। আজ যাঁরা বৃদ্ধ, তাঁরা নিজেদের জীবনের সব ধনসম্পদ বিনিয়োগ করেছিলেন সন্তানের জন্য, নিজের জন্য রাখেননি। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের কাছ থেকে এর একটি ক্ষুদ্র অংশও তাঁরা পাচ্ছেন না। কখনো দেখা যায়, সন্তান তার নিজের পরিবারের খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে, তাই পিতা-মাতাকে মনে করছে বোঝা। নিজে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে একটু ভালো থাকার জন্য বাবা-মায়ের ঠাঁই করে দিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে। একবার বৃদ্ধনিবাসে পাঠাতে পারলেই যেন সব দায়মুক্তি। এভাবে নানা অজুহাতে পিতা-মাতাকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অনেক নামীদামি বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, চাকরিজীবী যাঁরা একসময় খুব বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন, বৃদ্ধ বয়সে এসে নিজের সন্তানের দ্বারাই অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে বৃদ্ধাশ্রমে স্থায়ী বাসিন্দা হতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেক সন্তান বা আত্মীয়স্বজন আর তাঁদের কোনো খবরও নেন না। বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠানে বা ঈদের আনন্দের সময়ও পিতা-মাতাকে বাড়িতে নেন না।
তাই অনেকের জন্য বৃদ্ধনিবাস অতিপ্রয়োজনীয় বিকল্প। অনেক বৃদ্ধ আছেন যাঁর সন্তান নেই, নেই কোনো আত্মীয়, যার কাছে তিনি শেষ দিনগুলো কাটাতে পারেন। বৃদ্ধাশ্রমে তাঁদের জীবন আরেকটু আনন্দময় হবে চিন্তা করেই হয়তো তারা বুকে পাথর বেঁধেই পিতা-মাতাকে সেখানে পাঠিয়ে দেন। অনেকের সন্তান কাজ করেন দেশের বাইরে। তাঁরা টাকা পাঠাতে পারলেও পিতা-মাতাকে সময় দিতে পারেন না। এঁদের জন্য বৃদ্ধনিবাস এক চমৎকার ব্যবস্থা। থাকা-খাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে, শেষ জীবনের অবসর সময়টাকে উপভোগের সুযোগ করে দেয় এসব বৃদ্ধাশ্রম। এখানে যাঁরা থাকেন, তাঁরা সবাই মিলে একটা নতুন পরিবার তৈরি করে নেন। সমবয়সীদের সঙ্গে হেসেখেলে, স্মৃতিচারণা করে তাঁদের সময়টা ভালোই কেটে যায়।
বৃদ্ধাশ্রম অবহেলিত বৃদ্ধদের জন্য শেষ আশ্রয়। এখানে তাঁরা নির্ভাবনায়, সম্মানের সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে বাকি দিনগুলো কাটাতে পারেন। প্রয়োজনে অনেক বৃদ্ধাশ্রমে চিকিৎসারও সুন্দর ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সব প্রাপ্তির মাঝেও এখানে যা পাওয়া যায় না তা হলো পরিবারের সান্নিধ্য। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ তাঁর সন্তান, নাতিনাতনিদের সঙ্গে একত্রে থাকতে চান। তাঁদের সঙ্গে জীবনের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে চান। বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় পাওয়া যায়, সঙ্গীসাথি পাওয়া যায়, কিন্তু শেষ জীবনের এই পরম আরাধ্য আনন্দটুকু পাওয়া যায় না, যার জন্য তাঁরা এ সময়টায় প্রবল মানসিক যন্ত্রণা আর ভারাক্রান্ত হূদয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন।
বিভিন্ন উৎসবে, যেমন ঈদের দিনেও যখন তাঁরা তাঁদের সন্তানদের কাছে পান না, সন্তানের কাছ থেকে একটি ফোনও পান না, তখন অনেকেই নীরবে অশ্রুপাত করেন আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। যাঁরা নিজের পর্যাপ্ত সম্পদ ও সময় সুযোগ থাকার পরও অবহেলা করে পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে ভুলে যান, তাঁদের স্মরণ রাখা দরকার যে এমন সময় তাঁদের জীবনেও আসতে পারে।
ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ: ডিন, মেডিসিন অনুষদ। অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.