বাঘা তেঁতুল-ক্রোড়পত্র by সৈয়দ আবুল মকসুদ

সংবাদপত্রের ক্রোড়পত্র জিনিসটি হলো বোঝার ওপর শাকের আঁটি। কাগজের গুরুত্বপূর্ণ খবর ও বড় বড় লেখকের আকর্ষণীয় নিবন্ধগুলোই পাঠক পড়েন। বিশেষ করে পত্রিকার সঙ্গে লেজের মতো কিছু থাকলে সেসব পড়ার সময় কোথায় তাঁর! তা ছাড়া ক্রোড়পত্রের লেখা যে অতি সুখপাঠ্য ও ‘একবার শুরু করলে শেষ না করে পারা যায় না’ গোছের হবে তার নিশ্চয়তা কী? আর হলোই-বা অতি উন্নতমানের রচনা, বিষয়বস্তু যদি পাঠকের পছন্দ না হয়?


বালক-বালিকাদের কানে ধরে বাল্যশিক্ষার বই জোর করে পড়ানো যায়, পাঠককে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘাড়ে ধরে একটি লাইনও পড়ানো যাবে না।
কোনো সংবাদপত্র নিজের উদ্যোগে যখন কোনো উপলক্ষে বা বিষয়ে বিশেষ সংখ্যা অথবা মূল কাগজের সঙ্গে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। তাতে বিষয়ভিত্তিক লেখা থাকলেও ফরমায়েশি ও মতলবি লেখা থাকে না। তাই সেটা পাঠক শুধু পড়েন না, যত্ন করে তুলে রাখেন, পরে অবসরমতো মনোযোগ দিয়ে পড়বেন বলে। অন্যদিকে আমি অনেক আগে এক সমীক্ষা থেকে জেনেছি, কোনো গোত্রের স্পন্সর করা ক্রোড়পত্র কাগজটি হাতে আসামাত্র মুহূর্ত দেরি না করে সরিয়ে ফেলে। কখনো ঠাঁই পায় ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে।
আমাদের দেশে রেওয়াজ হয়েছে বিভিন্ন জাতীয় উপলক্ষে সরকার বা ক্ষমতাসীন দল পত্রপত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র স্পন্সর করায়। তাতে যেসব লেখা থাকে তার রচয়িতা হন সরকারি কর্মকর্তা অথবা সরকারঘনিষ্ঠ কবি-লেখক। ওগুলো খুব কম পাঠকই ছুঁয়ে দেখেন।
গতকাল এক ক্রোড়পত্রের কল্যাণে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। ক্রোড়পত্রের মূল্যবান রচনাগুলো পাঠ করার সৌভাগ্য এখনো হয়নি। আমাদের দেশের কাগজের প্রতিবেদন থেকে জানা গেল: ‘বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরতে বিলেতি পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ করছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য টাইমস-এর ১৯ ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রায় সোয়া কোটি টাকা খরচ করে ১২ পৃষ্ঠার এ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হবে।’ (প্রথম আলো)
লন্ডনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার জানান, ‘মূলত বাংলাদেশের ৪০ বছরের অর্জন, গণতন্ত্রের অভিযাত্রা—এসব বিষয় প্রতিপাদ্য করা হয়েছে প্রকাশিতব্য ক্রোড়পত্রে।’ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিঃপ্রচার অনুবিভাগের মহাপরিচালক জানিয়েছেন, ‘ক্রোড়পত্র প্রকাশের জন্য ব্রিটিশ দৈনিকটিকে দেড় লাখ ডলার সমপরিমাণ প্রায় সোয়া কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।... এটি তাদের খরচের এক-তৃতীয়াংশ।’
সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা দুই দিন আগেও বলেছেন, গত ৪০ বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল ১২ বছরের কম সময়। ধারণা করি, ৪০ বছরের যে অর্জনের কথা বলা হয়েছে, তাতে ১২ বছরের যাবতীয় কৃতিত্ব আওয়ামী লীগ পাবে। সেখানে আর কেউ ভাগ বসাতে পারবে না। কিন্তু পরবর্তী সাড়ে ২৮ বছরে অর্জন আদৌ যদি কিছু হয়ে থাকে, তার জন্য অতি সামান্য কৃতিত্বও জিয়াউর রহমান, আবদুস সাত্তার, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রাপ্য।
১৯৭৫ থেকে ৯০ পর্যন্ত ১৫ বছর জিয়া ও এরশাদের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় ছিল। তাঁরা ছিলেন সামরিক শাসক। তাঁদের অধিকাংশ সময় বাংলাদেশে গণতন্ত্র ছিল না। কিন্তু তাঁদের সময় বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি শুধু নয়, ম্যাক্রোপর্যায়ের অসামান্য উন্নতি হয়েছে। গ্রামে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম এনজিওর মাধ্যমে জিয়ার সময় শুরু হয়। পোশাকশিল্প বিকশিত হয় এরশাদের সময়। মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানিও বিশেষ মাত্রা অর্জন করে জিয়া-এরশাদের শাসনামলে। আশা করি, এসব কথা বলা হবে ১২ পৃষ্ঠার সাপ্লিমেন্টের সাড়ে আট পৃষ্ঠাজুড়ে।
বেগম খালেদা জিয়ার পাঁচ-পাঁচ দশ বছরের শাসন কালের কথা কিছুই যদি না থাকে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। অর্থনীতির উদারীকরণ উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে তাঁর সময়ই বাংলাদেশে প্রথম হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির অর্জনে তাঁর সরকারের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের অবদান অসামান্য, তা স্বীকার করার জন্য বিএনপিপন্থী হওয়ার দরকার নেই, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংই বলেছেন।
বাংলাদেশে পর্যটনের বিকাশের চিত্র নাকি তুলে ধরা হয়েছে। হাইকমিশনার জানিয়েছেন, ‘দৈনিকটি প্রতিদিন প্রায় ১৮ লাখ কপি ছেপে থাকে।’ প্রতিটি কপি যদি একজন পাঠক পড়েন, তাহলে ১৮ লাখ পাঠক পড়বেন। ১৮ লাখের মধ্যে যদি সেই ব্রিটিশ মহিলা থাকেন, যিনি কোনো ফ্লাইটে মধ্যরাতে ঢাকা পৌঁছেন। তাঁকে ম্যাডাম ম্যাডাম বলে এক টেক্সিচালক গুলশান এক হোটেলে নিয়ে আসেন। মিনিট দশেকের পথ। মিটার কাজ করছিল না। তাতে ক্ষতি কী? ভাড়া তো মোটামুটি জানাই আছে। মহিলা ৫০০ টাকার একখানি নোট বের করে চালকের হাতে দেন। চালক বলেন, ও রকম নোট আরও চারখানা পার্স থেকে বের করুন। মধ্যরাতে সিনক্রিয়েট হওয়ার ভয়ে এবং বড় রকম বেইজ্জতি থেকে বাঁচতে আড়াই হাজার টাকা দিয়ে তিনি হোটেলে গিয়ে ঢোকেন। হাউস অব লর্ডসের প্রবীণ সদস্য লর্ড এভেরিকে দেখি পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে বসে আছেন। আমাদের দেশি পোশাকে তাঁকে দেখে খুশি হলাম। ধন্যবাদ জানালাম। তিনি হাসলেন। চোখের নিমিষে তাঁর স্যুটকেসটি বিমানবন্দরে খোয়া গেছে। বিমানবন্দর থেকেই পায়জামা-পাঞ্জাবি কেনেন।
গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা সম্পর্কে কী লেখা হয়েছে, তা পড়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.