বদরুদ্দীন উমর:শ্রদ্ধাঞ্জলি by আনু মুহাম্মদ

দরুদ্দীন উমরের লেখার ধার ও ক্রোধের কথা সবাই জানেন। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার একটি প্রান্ত দেশ বাংলাদেশ। এ দেশ শাসন করছে একের পর এক বিভিন্ন নামে ও রূপে লুটেরা দখলদার চোরাই কোটিপতিরা। তাদের মেরুদণ্ড নেই, কিন্তু জনগণের বিরুদ্ধে হাতে নতুন নতুন দণ্ড আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে যাদের আমি আমার শিক্ষক হিসেবে বিবেচনা করি, যাদের প্রতি আমার অপরিসীম কৃতজ্ঞতা, বদরুদ্দীন উমর তাদের অন্যতম। গত কয়েক দশকে


যাদের সঙ্গে আমি এই জগৎ পরিবর্তনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করেছি, বদরুদ্দীন উমর তাদেরও অন্যতম। তিনি আমার সহযোদ্ধা, দীর্ঘ ২২ বছর আমরা সাংগঠনিকভাবে একসঙ্গে কাজ করেছি। উমর ভাইয়ের চিন্তা ও কাজের প্রভাব বলয় অবশ্য তৈরি হয়েছিল আরও আগে। তাই তাকে নিয়ে লিখতে গেলে নিজের কিছু কথাও না এনে উপায় থাকে না।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ যে অসংখ্য কিশোর-তরুণের মধ্যে নতুন একটি দেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তৈরি করেছিল আমিও তাদের একজন। স্বাধীনতার পর ক্রমে ক্রমে স্বপ্নভঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে অনেকের মতো আমার মধ্যেও যে পথ অনুসন্ধান চলতে থাকে সেই প্রক্রিয়ার মধ্যেই বদরুদ্দীন উমরের চিন্তা ও সক্রিয়তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটে। তার সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাতের বেশ কয়েক বছর আগেই আমি তার লেখালেখির সঙ্গে পরিচিত ও আকৃষ্ট হয়েছিলাম। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি আমি ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হই। তখন আমার বাসা খিলগাঁও, সাইকেলে প্রতিদিন কলেজে যেতাম। সেই অস্থির সময় কলেজে ক্লাস হতো কমই। সাইকেল থাকায় আমি সে সময় আরও অনেক জায়গায় সময় কাটাতে পারতাম বেশি। বলতে দ্বিধা নেই, সেটাই বেশি আনন্দদায়ক ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, পাবলিক লাইব্রেরি, তথ্য ও প্রকাশনা মন্ত্রণালয়ের গ্রন্থাগার ছিল আমার নিয়মিত গন্তব্য। কোনো একটি গ্রন্থাগারেই বদরুদ্দীন উমরের 'সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা, সাম্প্রদায়িকতা' পড়েছি। এ সময়ই তার ভাষা আন্দোলনের প্রথম খণ্ড আমার হাতে আসে। এ ঘোরাঘুরির মধ্যেই সংস্কৃতি পত্রিকার সঙ্গেও আমার যোগাযোগ ঘটে।
ষাটের দশকে বদরুদ্দীন উমর সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে যে লেখাগুলো লিখেছিলেন তা 'বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের' পথ দেখিয়েছিল। সে সময় বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজকে শিক্ষিত ও আত্মোপলব্ধিতে সক্ষম করে তুলতে, পাকিস্তানের শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে তাদের ভূমিকা নির্দিষ্ট করতে উমরের এ কাজগুলোর প্রভাব ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। 'পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি' বইটি আমি প্রথম পাঠ করি সে সময় আমার অন্যতম প্রিয় স্থান, তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে, বেশ কয়েকদিন ধরে। অসাধারণ এ গ্রন্থ পাঠের পর শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, সম্পর্কিত সামাজিক অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত অনুসন্ধানে তার গবেষণা ও লেখার পদ্ধতিও আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। আহমদ ছফা পরে যখন একদিন বললেন, 'আর কিছু দরকার নাই, উমর যদি জীবনে আর কিছু নাও করতেন তবুও এ গ্রন্থের জন্যই তিনি বাঙালি সমাজে চিরস্মরণীয় থাকবেন।' তা খুবই ঠিক মনে হয়েছে। তবে এরপর সৌভাগ্যক্রমে তিনি আরও অনেক কাজ করেছেন, এখনও একই রকম সক্রিয়তায় করে যাচ্ছেন।
শুধু লেখক, গবেষক ও শিক্ষক হিসেবে উমরের যে অবদান তার তুলনাই খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু তিনি এর মধ্যেই নিজেকে সীমিত রাখতে পারেননি। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্য দিয়ে তাত্তি্বক হিসেবে তার যে বিপ্লবী অবস্থান তৈরি হয় তার পূর্ণতার জন্যই তিনি সমাজের বিপ্লবী রূপান্তরের রাজনৈতিক সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। ষাটের দশকে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে লিখতে গিয়ে আইয়ুব-মোনেম সরকারের রোষানলে পড়ে তিনি এতটুকু উপলব্ধি করেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত থেকে তার পক্ষে বেশি দূর কাজ করা সম্ভব নয়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হন।
একপর্যায়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় রক্তচক্ষু থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য শিক্ষকতা ছেড়েছেন। পরেও সুযোগ বা আমন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষকতা বা অন্য কোনো পেশা গ্রহণ না করে, অনিশ্চয়তা ঘাড়ে নিয়ে, একদিকে সমাজ রাষ্ট্র ইতিহাস অনুসন্ধান এবং তার ওপর দাঁড়িয়ে নতুন ভবিষ্যৎ নির্মাণে রাজনৈতিক ভূমিকা পালনে আজীবন একনিষ্ঠ আত্মনিয়োগ করেছেন। এ যাত্রা বদরুদ্দীন উমরকে এ দেশের ইতিহাসে অনন্য অবস্থানে স্থাপন করেছে।
বদরুদ্দীন উমর সম্পাদিত সংস্কৃতি পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যেই এ পত্রিকার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সেই পত্রিকার নিয়মিত প্রধান লেখক ছিলেন বদরুদ্দীন উমর ও সইফ-উদ-দাহার। অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখা সে সময় তাতে প্রকাশিত হচ্ছিল। কয়েক সংখ্যা প্রকাশের পরই জরুরি অবস্থা ও সব পত্রপত্রিকা নিষিদ্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে সংস্কৃতি বন্ধ হয়ে যায় ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে।
উমর ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় ১৯৭৮ সালে, তখন তিনি বিপ্লবী রাজনীতিতে নতুনধারা তৈরিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। ততদিনে আমি লেখক শিবিরে যোগদান করেছি। শাহরিয়ার কবির ছিলেন আমাদের যোগাযোগ সূত্র। এরপর দ্রুত আমি সাংগঠনিক মতাদর্শিকভাবে যুক্ত হই। লেখক শিবির, কৃষক ফেডারেশন, ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটসহ বিভিন্ন ব্যানারে সক্রিয় হই। ১৯৮১ সালে সংস্কৃতি আবারও প্রকাশ শুরু হয়। এবার বদরুদ্দীন উমর সম্পাদক এবং আমি নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করি। সংস্কৃতির এ দায়িত্ব ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত আমার ওপর ন্যস্ত ছিল।
বদরুদ্দীন উমরের লেখার ধার ও ক্রোধের কথা সবাই জানেন। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার একটি প্রান্ত দেশ বাংলাদেশ। এ দেশ শাসন করছে একের পর এক বিভিন্ন নামে ও রূপে লুটেরা দখলদার চোরাই কোটিপতিরা। তাদের মেরুদণ্ড নেই, কিন্তু জনগণের বিরুদ্ধে হাতে নতুন নতুন দণ্ড আছে। খুনি দখলদারদের রক্ষা ও পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য যেমন আইনি কিংবা বেআইনি নানা পথ ও পদ্ধতি আছে; একই কারণে আছে ক্রসফায়ার, খুন-গুমসহ নানা আইনি কিংবা বেআইনি পথ। গণতন্ত্র আর শান্তির নামে সাম্রাজ্যবাদী বর্বরতায় বিশ্ব এখন ক্ষতবিক্ষত। কমিশন কিংবা ক্ষমতায় থাকার সমর্থনের বিনিময়ে দেশে এ সাম্রাজ্যবাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করাতেই শাসকশ্রেণীর বিভিন্ন দলের প্রতিযোগিতা। এ বিশ্বে, এ দেশে কোনো সংবেদনশীল মননশীল দায়িত্বশীল মানুষ ক্রোধ থেকে মুক্ত থাকতে পারেন?
আমাদের সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক যেন বাণিজ্যের মধ্যে বসতি গেড়েছে। বাজার, সুশীল সমাজ বা এনজিও জগৎ এ হলো এ ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের শুরু ও শেষ। এ ধরনের লোকের কাছে বুদ্ধিবৃত্তি তাই ফরমায়েশি বা তোষণমূলক বা অর্থ উপার্জনের মাধ্যম। সুবিধাবাদিতা, লেজুড়বাদিতা কিংবা দেউলিয়াত্ব প্রগতি চিন্তা ও রাজনীতির প্রবল শক্তিকে এখনও আটকে রেখেছে পুরনো বৃত্তে। বদরুদ্দীন উমরের মতো ব্যক্তি এরকম সমাজে অস্বস্তির কারণ হওয়ারই কথা। বাংলা ভাষায় মার্কসবাদী সাহিত্য উপস্থিত করায় উমর অগ্রণী, ইংরেজিতে পূর্ব পাকিস্তানের শ্রেণীসংগ্রাম ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যা লিখেছেন তা বাংলাদেশের সমাজ ইতিহাস নিয়ে ইংরেজি ভাষার আগ্রহী পাঠক গবেষকদের অনেক ভ্রান্তি দূর করবে নিশ্চিতভাবেই। বাংলাদেশে শোষণ-নিপীড়ন, বৈষম্য ও সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য নিয়ে উমরের ক্ষুরধার লেখা সমাজে অধিপতি চিন্তাকে বিরতিহীনভাবে মোকাবেলা করে যাচ্ছে। যেখানে ক্ষুদ্র তরল লোকজন সমাজের মাথা হিসেবে বিবেচিত হয়, যে সমাজে খলনায়করা নায়কের মর্যাদা পায় সেখানে উমরের মতো পণ্ডিত ও বিপ্লবী তাত্তি্বকের চিন্তা ও কাজ নিয়ে নীরবতা বিস্ময়কর নয়।
সততা, নিষ্ঠা, আপসহীনতা, দৃঢ়তা এসব শব্দই উমরের পরিচয়ে নিদ্বর্িধায় যোগ করা যায়। উমরের জীবনে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ এবং মানুষের মুক্তির রাজনীতির মধ্যে কোনো প্রাচীর নেই, একে অন্যের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। ষাটের দশকের শেষ থেকে উমর সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন। কৃষক-শ্রমিকদের সঙ্গেও অনেক কাজ করেছেন। এ দেশে বিপ্লবী আন্দোলন সংগঠন বিস্তারে ব্যর্থতা তো আছেই, নইলে বাংলাদেশের চেহারা তো ভিন্ন হতো। ব্যর্থতা না থাকলে ১৬ কোটি মানুষ নিজেদের মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করত, মানুষ ও প্রকৃতি মিলে এক অসাধারণ জীবন আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারতাম। এটা যে আমরা এখনও পারিনি সেই ব্যর্থতা সামষ্টিক, আমাদের সবারই তাতে দায় আছে।
কিন্তু উমর যেখানে সফল_ সেটা হলো তিনি হার মানেননি। বাংলাদেশে এখন বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষের যে লড়াই তা উমরের ভাষায়, '৭১-এর অসমাপ্ত মুক্তিসংগ্রামের জের'। পরাজয়, আত্মসমর্পণ আর দাসত্বের শৃঙ্খল প্রত্যাখ্যান করার শক্তিই এ সংগ্রাম এগিয়ে নেওয়ার পূর্বশর্ত। জীবনের এ পর্যায়ে এসে উমর গভীর তৃপ্তি আর প্রবল অহঙ্কার নিয়ে বলতে পারেন, তিনি আজীবন বিরামহীনভাবে এ শক্তি নিয়েই কাজ করেছেন। তিনি তার যথাসাধ্য ভূমিকা পালনে কিছুমাত্র দ্বিধা বা ক্লান্তি প্রদর্শন করেননি। ৮০তম জন্মদিনে শিক্ষক ও সহযোদ্ধা বদরুদ্দীন উমরকে গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

আনু মুহাম্মদ :অধ্যাপক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার

No comments

Powered by Blogger.