প্রতারণার নানা ফাঁদ

ভ্যতা যত উন্নত হচ্ছে মানুষের প্রতারণার ধরন যেন আরও বাড়ছে। নতুন নতুন পন্থা অবলম্বন করে সাধারণ মানুষকে সর্বস্বান্ত করছে এক শ্রেণীর অসৎ মানুষ। প্রতারণার নানা ফাঁদে জড়িয়ে দিশেহারা হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এসব নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন ইমরান ইমন যতই দিন যাচ্ছে নানা প্রতারণার জালে আটকে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন প্রতারণার ফাঁদ। নানা মাধ্যম আর প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিত্যনতুন কৌশলে প্রতারক


চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। সমাজের রল্প্রেব্দ রল্প্রেব্দ ঢুকে পড়ছে এসব প্রতারণা। রাজধানীসহ সারাদেশে নানামাত্রিক প্রতারণায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরল মানুষ।
কোথায় নেই প্রতারণা? খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সবরকম ভোগ্যপণ্যে ভেজাল এখন আমাদের গা-সওয়া ব্যাপার হয়ে গেছে। তার ওপর রয়েছে ওজনে কারচুপি। এমন কারচুপিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ক্রেতারা। শতভাগ গ্যারান্টির নিশ্চয়তা দিয়ে নানা রোগের চিকিৎসার কথা বলছে অনেক অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠান। সরল বিশ্বাসে চিকিৎসা নিতে গিয়ে প্রতারিত হচ্ছে মানুষ। গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকিতেও পড়ছে তারা। প্রায়ই জব্দ হচ্ছে ভেজাল ওষুধ তৈরির কারখানা। এসব ভেজাল ওষুধ ছড়িয়ে পড়ছে বাজারে। তাই চিকিৎসা নিতে গিয়েও আতঙ্কিত রোগীরা। এনার্জি ড্রিঙ্কসের আড়ালে চলছে রমরমা মাদকের ব্যবসা। ভণ্ড পীর-ফকির আর মাজার ব্যবসার কথা সবার জানা। কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের কারণে এদের খপ্পরে পড়ে চিকিৎসার অভাবে মারা গেছেন অনেক মুমূর্ষু রোগী। মাজারের আড়ালে মাদকের সাম্রাজ্য গড়ে উঠছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সরল বিশ্বাসে এদের কাছে গিয়ে প্রতারিত হচ্ছে মানুষ। জনসাধারণের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসায় নেমেছে এসব চক্র। এর ওপর শুরু হয়েছে 'ডিজিটাল' ভণ্ড-ফকিরের প্রতারণা। এরা প্রায়ই এসএমএসের মাধ্যমে প্রতারণা করছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে।
এছাড়া ঢাকাসহ সারাদেশেই অনেক এনজিও তৈরি করেছে প্রতারণার নতুন ফাঁদ। তাদের ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে বহু পরিবার। তারা অল্প সময়ে স্বল্প বিনিয়োগে অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে মানুষকে সর্বস্বান্ত করছে। তাদের কেউ কেউ ধরা পড়লেও বেশিরভাগই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
জাল নোটে ছেয়ে যাচ্ছে বাজার। এ বছর শুধু কোরবানির ঈদের আগেই চার-পাঁচটি জাল নোটের কারখানা উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অজ্ঞান পার্টি আর মলম পার্টি জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। এদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে বহু মানুষ। এমনকি পাত্র-পাত্রী খুঁজে দেওয়ার নামে অনেক ম্যারেজ মিডিয়াও প্রতারণা শুরু করেছে। প্রতারণা চলছে টিউশন মিডিয়ার নামেও। এদের প্রতারণার ফাঁদে পড়েছেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ূয়া বহু ছাত্রছাত্রী। এরা টিউশনি দেওয়ার নামে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন এবং দেয়ালে পোস্টারিং করে। পরে টিউশন প্রার্থীদের কাছ থেকে সদস্য ফির নামে টাকা নিয়ে সটকে পড়ে।
ইদানীং পার্টটাইম চাকরির নামে প্রতারণা করা হচ্ছে। অনেক স্থানে এদের পোস্টার দেখতে পাওয়া যায়। এরা চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে সিকিউরিটি মানির নামে টাকা নিয়ে চাকরি দেয় এবং কিছুদিন পরে এদের আর কোনো হদিস পাওয়া যায় না।
উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে অনেকে পড়ছেন ভুয়া এজেন্সির হাতে। এরা স্টুডেন্ট ভিসায় পাঠানোর নামে হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা। অনেক সময় অনেকে যেতে পারলেও পরে বিদেশে গিয়ে দেখছেন তাদের যে বৃত্তি বা চাকরির কথা বলা হয়েছে তা সঠিক নয়।
বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রতারণার মাত্রা আরও বেশি। অনেক সময় এজেন্সিগুলো বিদেশে পাঠানোর নামে টাকা নিয়ে পরে উধাও হয়ে যাচ্ছে। চাকরিপ্রার্থী দরিদ্র মানুষ হচ্ছেন সর্বস্বান্ত। বহু শ্রমিক অবৈধভাবে বিদেশে গিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। থাকতে হচ্ছে অনাহারে কিংবা জেলখানায়। অবৈধ পথে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করে সীমান্তরক্ষীর গুলিতে বা না খেতে পেয়ে মারা গিয়েছেন বহু বিদেশযাত্রী। নারীদের বিদেশে ভালো চাকরির কথা বলে নিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে যৌনপল্লীতে। শিশুদের পাচার করে দিচ্ছে উটের জকি হিসেবে। এ ছাড়া নতুন যুক্ত হয়েছে পর্নোগ্রাফির ব্যবসা।
দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে এসব প্রতারণা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী প্রতারণা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে প্রকৃত শিক্ষার অভাবকেই চিহ্নিত করলেন। তিনি বলেন, শিশুদের মধ্যে পারিবারিক শিক্ষা এখন তেমন জোরদার নয়। মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ কমে যাচ্ছে। তাই এখন মানুষ কোনো অপরাধ করতেই ভয় পাচ্ছে না। শিশুরাও এসব দেখে শিখছে। লোভ-লালসা বেড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া বেকারত্ব এবং মাদকাসক্তির কারণেও প্রতারণার ঘটনা বাড়ছে বলে তিনি মনে করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদুর রহমানও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন। তিনি প্রতারণার হার কমাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামাজিক শিক্ষার প্রতি জোর দেন। তিনি বলেন, 'সরকার যদি খারাপ কাজের শাস্তির পাশাপাশি সততার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করত তবে মানুষ আরও ভালো কাজে উৎসাহিত হতো।'
অধ্যাপক মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী এবং অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান দু'জনই সরকারের পাশাপাশি একটি নিয়ন্ত্রিত সামাজিক পরিবেশ তৈরির ওপর জোর দেন। তারা মনে করেন, মানুষের মাঝে বিবেকবোধ, ন্যায়-নীতির শিক্ষা গড়ে তুলতে পারলে এসব অপরাধ কমানো সম্ভব। এক্ষেত্রে তারা শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের কথাও বলেন। তারা আরও বলেন, এসব প্রতারক চক্রের সঙ্গে বহু প্রভাবশালী মহল জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগও থাকে অনেক সময়। তাই এককভাবে সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়ে এসব অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব নয়। এজন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্টদের মতে, কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতা এবং শিক্ষাই পারে অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে।

No comments

Powered by Blogger.