আরব বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহ by মুহাম্মদ রুহুল আমীন

ফ্রো-এশীয় আরব রাষ্ট্রগুলোতে সাম্প্রতিক ব্যাপক গণজাগরণের সিঁড়ি বেয়ে যে আর্থসামাজিক রাজনৈতিক কাঠামো নির্মিত হতে যাচ্ছে, তা এ অঞ্চলের জনগণের দীর্ঘ লালিত মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর রচিত হবে_এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আরব জাতি-রাষ্ট্রগুলোর ইসলাম ধর্মীয় অনুশাসন ও রীতিনীতি তাদের মূল্যবোধ তৈরিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। আরব বসন্তোত্তরকালে কয়েকটি দেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জনগণের রায় থেকে


এ উপসংহারে আসা যায় যে অন্য আরব রাষ্ট্রগুলোর রাজনীতি ও সমাজ নির্মাণেও তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ শক্তিশালী ভূমিকা পালন করবে।
পাশ্চাত্যের সেবাদাস গণবিচ্ছিন্ন স্বৈরশাসক তিউনিসিয়ার জাইন এল আবিদিন বেন আলীর বিরুদ্ধে পরিচালিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চেতনাদানকারী শক্তি ছিল দেশটির সর্ববৃহৎ আল-মানার বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে কালের সাক্ষী হিসেবে দণ্ডায়মান মসজিদটি, যা তদানীন্তন সাম্রাজ্যবাদীর ক্রীড়নক শোষক সরকারের বিরুদ্ধে পরিচালিত সংগ্রামী কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। বেন আলীর ক্ষমতাচ্যুক্তির আগ পর্যন্ত মসজিদটি বন্ধ রাখা হয়। ২৩ অক্টোবরের নির্বাচনে ইসলামপন্থী দল আল নাহদা অসাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। শাসকদলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠী প্রভাবশালী অবস্থানে থাকলেও শেষ পর্যন্ত তাদের ব্যাপক ভরাডুবি ঘটে। স্বৈরশাসকের আরোপিত নেকাব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার দাবিতে সম্প্রতি বৃহত্তম আল-মানার বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্ছ্বসিত চত্বরে তারুণ্যের স্লোগান রাজধানীসহ অন্য শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। ইসলামী সংস্কৃতির দাবিতে সমবেত এ উত্তাল জনস্রোত তিউনিসিয়ার ধর্মীয় মূল্যবোধের পুনর্জাগরণের ইঙ্গিত বহন করে।
গত নভেম্বরে মরক্কোর পার্লামেন্ট নির্বাচনে উদারপন্থী ইসলামী দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (পিজেডি) জয়ী হয়েছে। পিজেডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ বিন কিরান উচ্ছ্বসিত আবেগে ঘোষণা করেছেন, 'যাঁরা পিজেডিকে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের ধন্যবাদ। আমাদের সঙ্গে যাঁরা সরকার গঠন করবেন তাঁদের মূল লক্ষ্য দুটি_গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সুশাসন সৃষ্টি।' আল-জাজিরা ও এএফপি বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে উলি্লখিত হয়েছে যে পিজেডির জয়ের ফলে প্রতিবেশী দেশ তিউনিসিয়ার পর মরক্কোতেও উদারপন্থী ইসলামী দল ক্ষমতায় যাচ্ছে।
গত ২৮ নভেম্বর থেকে মিসরে পার্লামেন্ট নির্বাচন শুরু হয়েছে। মিসরের নির্বাচনপ্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ। তিন স্তরের নির্বাচনের প্রথম দফা অনুষ্ঠিত হয় ২৮ ও ২৯ নভেম্বর। এই দফায় কায়রো ও আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রধান এলাকাগুলো এবং ফাইয়াম, লুঙ্র, সাঈদ বন্দর, দামিয়েত্তা, কাফর আল শেখ ও লোহিত সাগর তীরবর্তী শহরগুলোতে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। গত ১৪ নভেম্বর দ্বিতীয় দফা ভোট অনুষ্ঠিত হয় এবং আগামী ৩ জানুয়ারি তৃতীয় দফায় ভোটাভুটি হবে।
মিসরের নির্বাচনে ১৮.৮ মিলিয়ন মিসরীয় ভোটারের ৬২ শতাংশের অংশগ্রহণের উচ্ছ্বসিত রায়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ইখওয়ানের এফজেপি প্রথম স্থান অধিকার করেছে এবং কট্টরপন্থী ছালাফি গ্রুপ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। তিউনিসিয়া ও মরক্কোর মতো মিসরেও ধর্মীয় রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জনগণের রায় নিয়ে ক্ষমতায় আরোহণ করতে যাচ্ছে।
মিসরের ইসলামপন্থী দল ও ক্ষমতাসীন সামরিক পরিষদের চাপে উদারপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠী একেবারেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। উদারপন্থীদের দ্বিধাগ্রস্ততা ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মানবাধিকারকর্মী খালিদ আবদুল্লাহ বলেন, 'তাহরির স্কয়ারের বিক্ষোভ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অন্যতম অগ্রণী ভূমিকা রাখলেও উদারপন্থীরা বিপ্লবের মর্মার্থ অনুধাবনে এবং গণমানুষের চাওয়া-পাওয়া ও স্বপ্নপূরণের অঙ্গীকার রক্ষায় সক্ষম নয় বলেই জনগণের মূল্যায়ন।
১৯১৯ সালের মতো এবারও একই নাটক মঞ্চস্থ হলো কায়রোসহ মিসরের রাস্তায় রাস্তায়। বিক্ষোভকারীরা পুঁজিবাদী পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতি অনুগত ও সহানুভূতিসম্পন্ন উদারপন্থী বা সেক্যুলার গোষ্ঠীকে কখনো মিসরের দেশ ও মানুষের বিরুদ্ধে সমর্থন দেবে না। ইতিহাসবিশারদ অরুণ জেকস মন্তব্য করেছেন, মিসর যেন ১৯৬১ সালের তুরস্ক, ১৯৬৮ সালের ফ্রান্স, ১৯৭৯ সালের ইরান ও ১৯৮৯ সালের পোল্যান্ডের ভূমিকায় আমূল পরিবর্তনের রঙ্গমঞ্চ হতে চলেছে।
গাদ্দাফি-উত্তর লিবিয়ায় গণতান্ত্রিক বিপ্লবে অংশগ্রহণকারীরা চাঁদতারাখচিত পতাকা, তাদের স্লোগানের ভাষা, ব্যবহৃত ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ডের শব্দচয়ন, মুহুর্মুহু 'আল্লাহু আকবর' (আল্লাহ মহান) ধ্বনি, এনটিসি নেতা মোস্তফা আবদুল জলিলের ইসলামী শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা ভবিষ্যৎ লিবিয়ায় ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার পূর্বাভাস প্রদান করছে।
আরব বসন্তের সংক্রমণ সিরিয়া, কুয়েতসহ অন্য আরব রাষ্ট্রগুলোতেও দ্রুত বিস্তৃত হবে এবং ইতিমধ্যে ইসলামী সংস্কৃতির পেলব-পরশে লালিত ধর্মীয় চেতনার যে দীপ্তি অন্য আরব রাষ্ট্রগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছে, তার বিস্তারিত আলোকরশ্মি আস্তে আস্তে আফ্রো-এশীয় আরব জাতি-রাষ্ট্রগুলোতে প্রতিবিম্বিত হবে। আরব বসন্তোত্তর আরব রাষ্ট্রগুলোতে সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের প্রেক্ষাপটে ইসলামের মূলনীতিগুলো দ্রুত বিকাশমান স্বাধীন আরব রাষ্ট্রগুলোর জাতীয় পুনর্গঠনের ভিত্তি ও কাঠামো রচনায় অপ্রতিরোধ্য ভূমিকা রাখবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
john_nigjhar@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.