বিশিষ্টজনের প্রতিক্রিয়া : অধিকার প্রতিষ্ঠায় ঐকমত্য জরুরি

দেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশিষ্টজনরা বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মানবাধিকার রক্ষায় ঐকমত্য অত্যন্ত জরুরি। মানবাধিকার শুধু লিপিবদ্ধ কিছু অধিকার নয়, এটি মানুষের
জন্মগত অধিকার। সমাজে বৈষম্যহীন জীবন মানাধিকারের মূল কথা। কিন্তু এখন কোনো অপশক্তি নয় আমরাই আমাদের সেই অধিকার লঙ্ঘন করছি। তাদের মতে, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে হত্যা, ক্রসফায়ার, খুন, গুম দূরে থাক কাউকে গালি দেয়া বা অশালীন আচরণও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। যেকোনো মাত্রায় যেকোনো চরিত্রে যেকোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন গ্রহণযোগ্য নয়।


আমার দেশের ৭ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ‘মানবাধিকার’ শীর্ষক লেখা ও সাক্ষাত্কারে তারা এসব কথা বলেছেন।
তাদের মতে, যারা ব্যক্তির মর্যাদা ও অধিকার মেনে সে অনুযায়ী দেশের ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়ন করেন এবং সেই অধিকারের রাষ্ট্রীয় নিশ্চয়তা বাস্তবায়ন না করেন তাহলে তারা গণতন্ত্রের দুষমন। আমাদের কাজ হচ্ছে গণতন্ত্রের দুষমনদের বিরুদ্ধে লড়াই করা। জনগণের শক্তি বা গণতান্ত্রিক শক্তিকে সংগঠিত করে অগণতান্ত্রিক মানবাধিকার বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে হবে। মানবাধিকারের জন্য যেকোনো ধরনের লড়াই শেষ বিচারে মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই, মানুষ হিসেবে স্বীকৃতির লড়াই। রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত থাকেন তারা যদি পরবর্তী সময়ে নিজেদের বিরোধী দল মনে করেন তাহলেও মানবাধিকার পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হবে। তবে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি চাইলে শুধু ক্ষমতাসীন দলকে বদলালেই চলবে না। বিরোধী দলকেও বদলাতে হবে।
মানবাধিকার প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যরিস্টার রফিকুল হক বলেন, শুধু লিপিবদ্ধ কিছু অধিকারকে মানবাধিকার বলা যায় না। এটা হচ্ছে মানুষে মানুষে বৈষম্যহীন জীবন। সর্বক্ষেত্রে, সর্ববিষয়ে, সর্বজন স্বীকৃত একে অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং ভ্রাতৃত্ববোধসম্পন্ন আচরণ করাই হচ্ছে মানবাধিকার। কারও অন্য কাউকে পছন্দ নাও হতে পারে, কারও মতামত অন্যের পছন্দ হবে না; তার মানে এই নয় যে, পছন্দ না হলে গালাগাল করতে হবে। গালাগাল করা বা অশালীন ব্যবহার করা মানবাধিকার পরিপন্থী। কারও বক্তব্য বা মতামত পছন্দ না হলে যথাযথ সম্মানজনকভাবে নিজের পাল্টা মতামত ব্যক্ত করাই হচ্ছে মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো। এখন অফিস-আদালতে মানুষকে মানুষ বিবেচনায় না নিয়ে কাজ হচ্ছে দলীয় বিবেচনায়। মেধার বিবেচনায় নয়—চাকরি হয় দলীয় বিবেচনায়, পদোন্নতি হয় দলীয় পরিচিতি ও বিশেষ ব্যক্তিদের সুপারিশে। এটাও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। অন্যায় সুযোগ দিতে গিয়ে যিনি বঞ্চিত হচ্ছেন, তার মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। কারও সঙ্গে কটু কথা না বলে সদাচরণ করা, হাসিমুখে কথা বলা—এগুলোও মানবাধিকার।
বিশিষ্ট কলামিস্ট ও সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ বলেন, দেশ এমন এক পরিস্থিতিতে এসে পৌঁছেছে যেখানে অপশক্তির প্রয়োজন নেই। আমরাই আমাদের ছেলেদের প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করি। আমরা আমাদের ছেলেকে ধরে তার উরুতে গুলি করি। আমরা যুবকের মস্তক কেটে নিই। আমরা মৃত্যুকে শত্রুপক্ষ আলিঙ্গন করুক এটাই কামনা করি। এমন পরিস্থিতি মানবসমাজকে আর কোন স্তরে ও পর্যায়ে নিয়ে যাবে সেদিক লক্ষ্য করা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু এক শ্রেণীর রক্তপায়ী মানুষ বিপরীত ধারার লোকগুলোকে মৃত্যুর অবগাহনে নিয়ে যেতে চায়। এমন পরিস্থিতি বাঞ্ছনীয় নয়, সভ্যতাবিরোধী ও জীবনের পরিপন্থী।
বিশিষ্ট কলামিস্ট বদরুদ্দীন উমর বলেন, বাংলাদেশে এখন মানবাধিকারের করুণ অবস্থা, জনগণের জীবনে এক দারুণ দুর্দিন। কারখানা শ্রমিকসহ সব ধরনের শ্রমজীবী মানুষকে এখন মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে, জিনিসপত্রের মূল্য আকাশচুম্বী করে শাসকশ্রেণীর, বিশেষত সরকারদলীয় লোক অবাধে ও ব্যাপকভাবে লুণ্ঠন করছে, জনগণের পকেট মারছে। সেইসঙ্গে সরকারি নির্যাতন এখন এসে দাঁড়িয়েছে এক চরম পর্যায়ে। সভা সমিতি মিছিলের কোনো গণতান্ত্রিক অধিকার এখানে নেই। মিটিং মিছিল করলে পুলিশ দিয়ে তারা জনগণের ওপর নিষ্ঠুর আক্রমণ চালায়। মানুষকে রাস্তায় ফেলে তার বুকের ওপর বুটজুতা নিয়ে চড়াও হতেও দেখা যায় পুলিশকে। মানুষের অধিকারের ওপর এমন হামলা যেখানে হয়, সে দেশে গণতন্ত্র আছে—এ দাবি কেউ করতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, প্রকৃতিগত এই মনুষ্যত্বের স্বীকৃতি ও মানবিক অধিকারের জন্য লড়াই একই ব্যাপার। দুইয়ের অর্থ অভিন্ন। মানবাধিকার প্রশ্ন যখনই আসে, তখনই এ বিষয়টি মনে রাখা দরকার। শোষক, শাসক মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীরা এ বিষয়টি সর্বদাই আড়ালে রাখার চেষ্টা করে। মানবাধিকারের জন্য যেকোনো ধরনের লড়াই শেষ বিচারে মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই, মানুষ হিসেবে স্বীকৃতির লড়াই।
বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী কলামিস্ট কবি ও সমাজ চিন্তক ফরহাদ মজহার বলেছেন, মানবাধিকার মাপামাপি করার কোনো বিষয় নয় যে কত মাত্রার লঙ্ঘন গ্রহণযোগ্য, আর কত মাত্রায় তার লঙ্ঘন গ্রহণযোগ্য হবে না। যে মাত্রা বা যে চরিত্রেরই যেকোনো প্রকার মানবাধিকার লঙ্ঘন কোনো অবস্থাতে কখনই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যারা ব্যক্তির মর্যাদা ও অধিকার মেনে সে অনুযায়ী দেশের ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়ন করেন এবং সেই অধিকারের রাষ্ট্রীয় নিশ্চয়তা বাস্তবায়ন না করেন তাহলে তারা গণতন্ত্রের দুষমন। এ ক্ষেত্রে আমাদের কাজ হচ্ছে গণতন্ত্রের দুষমনদের বিরুদ্ধে লড়াই করা। জনগণের শক্তি বা গণতান্ত্রিক শক্তিকে সংগঠিত করে অগণতান্ত্রিক মানবাধিকার বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। এর মাঝখানে কোনো পথ নেই। তিনি বলেন, মানবাধিকার রক্ষার কাজ নিছকই কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার আহাজারির বিষয় নয়। এটা ব্যক্তির অধিকার।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনবিদ ও সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, রাষ্ট্র ও ক্ষমতাসীন দলই মানবাধিকার লঙ্ঘনের মূল হোতা হিসেবে কাজ করে। রাষ্ট্রের মদত ছাড়া কারও পক্ষেই আইন ভঙ্গ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুযোগ নেই। যেকোনো বিবেচনায় দেশের সর্বজনীন মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। নতুন করে এখন গুপ্তহত্যা ও গুম-আতঙ্ক তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে দেশবাসীকে। রাষ্ট্র কিছু লোককে বেআইনিভাবে মানুষ হত্যার জন্য সরকারিভাবে লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছে। বিরোধী দল ও ভিন্নমতের নাগরিকদের নিয়মতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকারের আওতাধীন রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রতিহত করার নামেও মানবাধিকার লঙ্ঘন। ক্ষমতাসীনরা যদি নিজেদের পরবর্তী টার্মের বিরোধী দল মনে করে, তাহলেই মানবাধিকার পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হবে। এছাড়া সংবাদমাধ্যমসহ দেশের সব শ্রেণী-পেশার নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে এখন সরকারপ্রধানদেরও বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমাদের সরকারপ্রধানকেও এ বিষয়টি মনে রাখা উচিত।

No comments

Powered by Blogger.