সর্বনাশা মাদক by ইমদাদুল হক মিলন

মাদকসেবী ছেলে মাদকের টাকা চেয়েছে বাবার কাছে। বাবা দেবেন না। তিনি জানেন মাদক তাঁর সন্তানকে ধ্বংস করছে, তাঁর পরিবারকে ধ্বংস করছে। ছেলে উত্তেজিত হয়ে খুন করে ফেলল বাবাকে। খুন করে লাশ পুঁতে রাখল বাবার ব্যবসাকেন্দ্রের মেঝেতে। মেঝে খুঁড়ে পুলিশ উদ্ধার করল বাবার লাশ। মাত্র কয়েক দিন আগে পুরান ঢাকায় ঘটে গেল এই ঘটনা।প্রায় প্রতিদিনই এ রকম ঘটনা ঘটছে দেশের আনাচে-কানাচে।বছর দুয়েক আগে ভয়ংকর এক কাণ্ড ঘটেছিল এই ঢাকা শহরে। মা খুন করালেন মাদকাসক্ত ছেলেকে। এই কাজে মাকে সাহায্য করল ডাক্তারি পড়া মেয়ে। সমগ্র জাতি শিউরে উঠেছিল ঘটনার বিবরণ শুনে।
মাদকাসক্ত ছেলেকে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছেন বাবা, এ রকম প্রায়ই শুনি। কিন্তু মা খুন করালেন ছেলেকে, বোন খুন করাল ভাইকে, এ রকম ঘটনা বিস্ময়কর।
ঘটনার বিবরণ পড়ে আমি আঁতকে উঠেছি। কেন খুনের পথ বেছে নিলেন মা? কেন মেয়ে তাঁকে সাহায্য করল? কতটা নিরুপায় হলে এ রকম পথ ছেলের জন্য বেছে নেন মা, ভাইয়ের জন্য বেছে নেয় বোন? যাঁদের জীবনে এই ধরনের সর্বনাশ ঘটে তাঁরা ছাড়া অন্য কেউ এটা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারবেন না।
টঙ্গীর এক বাড়ির ভাড়াটিয়ার ঘরে মাদকের আড্ডা বসে। বাড়িঅলার স্ত্রী বাধা দেওয়ায় মাদকসেবীরা ছুরিকাঘাতে তাঁকে হত্যা করে। এ রকম হত্যাকাণ্ড, অনাচার আর অবিশ্বাস্য সব কাণ্ড ঘটাচ্ছে মাদকসেবীরা। পারিবারিক ও সামাজিক জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছে মাদকের কারণে।
মাদকের ভয়ংকর থাবায় বিপর্যস্ত হয়ে গেছে হাজার-লাখো পরিবার। এক পরিবারের একটি ছেলে মাদকে আসক্ত হলে ধীরে ধীরে সেই পরিবারটি ধ্বংস হয়ে যায়। একজন মাদকসেবী হয়ে ওঠে পুরো পরিবারের ধ্বংসের কারণ। প্রথম প্রথম হাতখরচের অতিরিক্ত টাকা নিতে শুরু করে পরিবার থেকে, তারপর বাড়ির জিনিসপত্র চুরি, মায়ের গহনা, বোনের শাড়ি, বাবার হাতঘড়ি, ঘরের টেলিভিশন-কম্পিউটার। তারপর চুরি-ছিনতাই শুরু করে বাইরে। কত বড় এবং ভালো পরিবারের শিক্ষিত ছেলে এভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের একটি বড় অংশ আচ্ছন্ন হয়ে গেছে মাদকে। বছরে ২৪-২৫ হাজার কোটি টাকার মাদকের ব্যবসা হচ্ছে বাংলাদেশে। ভাবা যায়!
বর্ডারের ওপার থেকে আসছে ফেনসিডিল। প্রতিদিন আবিষ্কৃত হচ্ছে নতুন নতুন নেশার দ্রব্য। টিকটিকির লেজ, জুতা তৈরির আঠা, ইয়াবা, হেরোইনসহ কত নতুন নতুন নেশাদ্রব্য। মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কত রাঘব বোয়াল। তাদের টিকিটিও ছোঁয়া যাচ্ছে না। মাদকসেবীদের পুলিশ বা র‌্যাব ধরে নিয়েও সামলাতে পারে না। নেশায় কাতরাতে থাকা নেশারুকে বাঁচিয়ে রাখাই দায়। নিরুপায় হয়ে তাদের ছেড়ে দিতে হয় কিংবা মাদক নিরাময় কেন্দ্রে পাঠাতে হয়।
প্রতিদিন নেশার মরণ ছোবলে প্রাণ যাচ্ছে কতজনের, সেই হিসাব পাওয়া মুশকিল।
এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? কেমন করে নেশার ভয়ংকর থাবা থেকে তাজা প্রাণগুলোকে রক্ষা করতে পারি আমরা? বিশেষজ্ঞরা বলেন, পরিবার থেকেই শুরু হওয়া উচিত সচেতনতা। মা-বাবা, ভাইবোন, অভিভাবকদের তীক্ষ্ন নজর রাখা দরকার তাঁদের ছেলেটি কার সঙ্গে মিশছে, কী করছে। তাকে আগলে রাখা, তার পরিচর্যা করা এবং মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করা। আর যারা ইতিমধ্যে মাদকে আসক্ত হয়ে গেছে তাদের প্রতি বিরূপ না হয়ে সঠিক চিকিৎসা, পরিচর্যা এবং ভালোবাসার মধ্য দিয়ে মাদকের জগৎ থেকে ফিরিয়ে আনা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর হওয়া উচিত মাদক ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে। মাদক ব্যবসায়ী যে স্তরের, যত ক্ষমতাবানই হোক তাকে ছাড় না দেওয়া। আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা। মাদকের ঘাঁটিগুলো সমূলে ধ্বংস করা। বর্ডারের ওপার থেকে মাদক যাতে কিছুতেই ঢুকতে না পারে দেশে, সে ব্যাপারে কঠিন হওয়া। আর মাদকবিরোধী আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা।
আমরা জেনেছি, আইনের আওতার কারণে নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়ে গেছে অনেক ধরনের মাদক, অপ্রচলিত মাদকের ঝুঁকিতে পড়েছে দেশ। আইনের সংশোধনী ঝুলে আছে চার-পাঁচ বছর ধরে। প্রচলিত মাদক হিসেবে চিহ্নিত না_এমন নেশাজাতীয় দ্রব্যের দিকে ঝুঁকেছে মাদকসেবীরা। আইনি জটিলতার কারণে এ ধরনের মাদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া যাচ্ছে না। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মাদকের ধরনপরিধি এবং দণ্ড বাড়ানোর আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে বছর চারেক আগে, কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি সেই আইন। খসড়া সংশোধন ঘুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় কিংবা সংস্থায়। সংশোধনীটি কার্যকর হলে বিভিন্ন ধারার আওতায় প্রায় ৮০০ মাদকের উপাদান বিনা অনুমোদনে বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। দণ্ডবিধির কিছু দুর্বল দিকও সংশোধিত হবে। আইনের যথার্থ প্রয়োগ আর রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের সচেতনতা ছাড়া মাদকের ভয়ংকর থাবা থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব। মানুষের কল্যাণের কথা, রাষ্ট্রের কল্যাণের কথা যাঁরা ভাবেন, দেশপ্রেমিক জনগণ, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা মাদকের ভয়াবহতা থেকে আমাদের বাঁচাতে পারে। আসুন, এই মুহূর্ত থেকে মাদকের বিরুদ্ধে আমরা একটা যুদ্ধে নামি। বাঙালি যোদ্ধা জাতি, লড়াই করা জাতি। আমাদের যাবতীয় বড় অর্জনের পেছনে আছে যুদ্ধ, লড়াই। বায়ান্ন সালে আমরা মাতৃভাষাকে রক্ষা করেছি যুুদ্ধ করে, বুকের রক্ত দিয়ে। একাত্তর সালে পাকিস্তানিদের হাত থেকে দেশ মুক্ত করেছি ৯ মাসের ভয়ংকর যুদ্ধ করে ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ_ আমাদের এই বিশাল অর্জনগুলোর মূলে ছিল তারুণ্যের শক্তি। দেশ বাঁচে তারুণ্যের শক্তিতে, দেশ এগিয়ে নেয় তরুণরা।
আসুন, আমরা কারো দিকে না তাকিয়ে তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগাই, তরুণসমাজকে একত্র করে, সচেতন করে মাদকের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধে নামি, একটা সংগ্রামে নামি। জয়ী আমরা হবই। জয়ী আমাদের হতেই হবে। নয়তো মাদকের কারণে আমাদের বড় অর্জনগুলো ম্লান হয়ে যাবে।

No comments

Powered by Blogger.