মধুচন্দ্রিমায় চিরবিদায়

বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমায় যাওয়া হয়নি তাদের। কাজের চাপে লিপু সময় বের করতে পারেননি। সময় হয়নি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু টুসীরও। একসময় সিদ্ধান্ত হয়, দুই নবদম্পতি (লিপু-ইরা, নয়ন-টুসী) একসঙ্গে মধুচন্দ্রিমায় যাবেন। শেষ পর্যন্ত দেশের বাইরে নয়, রাজধানীর সনি্নকটে গাজীপুরের বাংলাবাজারের শিরুনি কটেজেই মধুচন্দ্রিমায় যান এ দুই দম্পতি। কিন্তু কে জানত, এখানেই মৃত্যু হবে দুটি নবীন স্বপ্নের। পানিতে ডুবে চিরতরে হারিয়ে যাবে তিনটি তাজা প্রাণ।


গাজীপুরের পিকনিক স্পট শিরুনি কটেজের পুকুরেডুবে নিহত হয়েছেন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ৭১-এর নির্বাহী প্রযোজক তানভীর জাহিদ নয়ন, তার বন্ধু ইন্টেরিয়র ডিজাইনার জামিল আক্তার লিপু এবং তার স্ত্রী আসমা আক্তার ইরা। গতকাল শুক্রবার ভোররাতে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় তারা তিনজন ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। প্রথমে অসতর্কতায় পুকুরঘাট থেকে পানিতে পড়ে যান ইরা। তাকে বাঁচাতে তখনই পুকুরে ঝাঁপ দেন নয়ন। এ দু'জনকে উদ্ধার করতে পানিতে নামেন লিপু। তানভীর জাহিদ নয়ন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক নূহ-উল আলম লেনিনের বড় মেয়ে সুবর্ণা সেঁজুতি টুসীর জামাতা। বৃহস্পতিবার রাতে তারা ওই স্পটে গিয়েছিলেন।
এ ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী সুবর্ণা সেঁজুতি টুসী তার পরিবারের সদস্যদের কাছে জানান, গাজীপুরের শিরুনি পিকনিক স্পটের পুকুরঘাটে বসে সারারাত গল্প করেন তারা চারজন। ভোর সোয়া ৫টায় হাত ভেজাতে গিয়ে পুকুরের পানিতে পড়ে যান ইরা। তাকে বাঁচাতে তখনই পানিতে ঝাঁপ দেন নয়ন। এসময় স্ত্রী ইরাকে উদ্ধারের জন্য লিপুও ঝাঁপ দেন পানিতে। তাদের মধ্যে কেবল নয়নই সাঁতার কাটতে পারতেন। আর লিপু-ইরা সাঁতার জানতেন না। তাই তারা দু'জন বাঁচার জন্য নয়নকে জাপটে ধরেন। এতে একসঙ্গে তিনজনই পানিতে তলিয়ে যান। এসময় টুসী পিকনিক স্পটের লোকজনকে খবর দিলে তারা এসে তিনজনকে উদ্ধার করেন। তখনই তাদের নিয়ে আসা হয় উত্তরার জাহানারা ক্লিনিকে। কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের তিনজনকেই মৃত ঘোষণা করেন।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে তানভীর জাহিদ নয়নের বাসায় গিয়ে দেখা যায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। গুলশান নিকেতনের ৪ নম্বর রোডের বি ব্লকের কেয়ারী কিটন ভবনের পাঁচতলায় সপরিবারে থাকতেন নয়ন। তার মৃত্যুর খবরে বাসায় ছুটে আসেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, প্রধানমন্ত্রীর সংস্থাপন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। তারা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক শোকার্ত নূহ-উল আলম লেনিনকে সান্ত্বনা দেন ও নিহতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। এসময় নূহ-উল আলম লেনিন কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, আমার সোনার টুকরো জামাতা নয়নের মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। এছাড়া মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, শাকিল আহমেদ, অমিতাভ রেজা ও সামিয়া জামানসহ অনেকেই ছুটে আসেন প্রিয় মানুষটিকে শেষবারের মতো দেখার জন্য।
নিহতের খালু আবুল খায়ের সমকালকে জানান, ব্যবসায়ী বখতিয়ার জাহিদ ও দিলরুবা জাহিদ দম্পতির ছেলে তানভীর জাহিদ নয়ন (৩২) নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করেছেন। চ্যানেল ৭১-এর নির্বাহী প্রযোজক হিসেবে কাজ করার আগে নয়ন বিবিসি, এটিএন, সিএসবি ও একুশে টিভিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেন। অনলাইন পত্রিকা মেঘদূতের অনলাইন এডিটর হিসেবে তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন। তাদের গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের নারিকেলবাড়িয়া এলাকায়। গুলশানের নিকেতনের বাসায় তারা ভাড়া থাকেন। এর আগে ২০০৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নয়নের একমাত্র বোন সানজিদা জাহিদ তিথি মারা যান।
আবুল খায়ের আরও জানান, দু'মাস ১০ দিন আগে নয়নের সঙ্গে বিয়ে হয় নূহ-উল আলম লেনিনের বড় মেয়ে সুবর্ণা সেঁজুতি টুসীর। বিয়ের পর কাজের চাপে নবদম্পতি মধুচন্দ্রিমায় যাওয়ার সুযোগ পাননি। তাই তারা ঢাকার কাছাকাছি ওই পিকনিক স্পটে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। টুসী ও লিপু মিরপুরের মনিপুরী স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে একসঙ্গে লেখাপড়া করেছেন। সম্প্রতি অল্পদিনের ব্যবধানে লিপু-ইরা ও নয়ন-টুসীর বিয়ে হওয়ায় তারা একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় ঢাকা থেকে তারা গাজীপুরের উদ্দেশে রওনা হন। রাত ১১টার দিকে শিরুনি পিকনিক স্পটে তারা পেঁৗছেছিলেন। রাতের খাবার খেয়ে দুই নবদম্পতি পুকুরপাড়ে হাঁটাহাঁটি করেন ও ছবি তোলেন। এরপর পুকুরঘাটে বসার পরই ওই দুর্ঘটনা ঘটে।
গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, শিরুনি কটেজের কেয়ারটেকার গোলাম মোস্তফার ছেলে লিটন জানান, তাদের চারজনের সঙ্গে ল্যাপটপ ও ক্যামেরা ছিল। তারা সারারাত না ঘুমিয়ে ছবি তোলেন, ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করেন এবং হৈ-হুল্লোড় করে কাটান। ভোর ৫টার দিকে লিটন তাদের কটেজের পুকুরঘাটে গল্পগুজব করতে দেখেন। এর কিছুক্ষণ পর নয়নের স্ত্রী টুসী চিৎকার করতে থাকেন। তার চিৎকারে পাশের কটেজের ভাড়াটে কাশেম ও হুমায়ুন ছুটে আসেন। তারা পুকুর থেকে লাশ তিনটি উদ্ধার করেন।
এদিকে গতকাল দুপুরে গুলশান নিকেতনে গিয়ে দেখা যায়, নয়নের লাশের পাশে বাকরুদ্ধ স্ত্রী টুসী বসে আছেন। থেমে থেমে তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছিল। প্রিয়জনরা তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিতে পারছিলেন না। বিকেল সোয়া ৩টায় নয়নের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্তানে। দাফনের আগে গুলশান নিকেতন জামে মসজিদ ও কবরস্থানে তার পৃথক দুটি জানাজা হয়।
লিপু-ইরা দম্পতির করুণ মৃত্যু : মাত্র পাঁচ মাস আগে পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে করেন জামিল আখতার লিপু। স্ত্রী আসমা আক্তার ইরা আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (এআইইউবি) বিবিএর শেষ বর্ষের ছাত্রী। লিপু-ইরা দম্পতির বিয়ে উপলক্ষে গত মে মাসে রাজধানীর কাজীপাড়ার ৫৩৪/১ নম্বর বাড়িটি (ক্ষণিকালয়) আলোকিত ছিল লাল-নীল বাতিতে। বাড়িটি ঘিরে ছিল উৎসবের আমেজ। মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় ওই বাড়িতে নেমে আসে শোকের ছায়া। গতকাল শুক্রবার ওই বাড়িতে জড়ো হয় শত শত মানুষ। সবারই চোখের কোনায় চিকচিক করছিল অশ্রু। কেউ কেউ বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েন। একই ছাদের নিচ থেকে দুই নবদম্পতির এমন বিদায় কেউ মেনে নিতে পারছিলেন না। বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন লিপুর মা ফজলুন্নেসা। শুধু স্বজন নয়, শোকে স্তব্ধ গোটা মনিপুর।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে লিপুর মা ফজলুন্নেসা বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলেমেয়েকে একাই লালনপালন করেছি। লিপুর এমন মৃত্যু আমি মেনে নিতে পারব না। আমি বেঁচে থাকতে লিপুর মরামুখ দেখতে হলো। আজ (গতকাল) সকাল ৬টার দিকে হঠাৎ সেলিম নামে পরিচিত এক ব্যক্তি আমাকে ফোন করে। প্রথমে ভেবেছি আমার বাবা (ছেলে লিপু) ফোন করেছে। পরে দেখি সেলিম। সেলিম জানায়, লিপু ও ইরা দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে। এরপর জানতে পারি, পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন সংবাদটি।
ভাইয়ের লাশের পাশে বিলাপ করে মুশফিকা আক্তার সীমা বলছিলেন, 'ভাইরে, এমন ফাঁকি দিয়ে তুই চলে যেতে পারলি। চির বিদায় নিতে তোর কষ্ট হলো না। আমি তোকে আর দেখতে পারব না। আমার ভাইকে চুমো খেতে পারব না।'
মেয়ে আর জামাইয়ের এমন মৃত্যুতে শোকে পাথর ইরার বাবা ইসরাইল মিয়া। তিনি জানান, এক ছেলে আর এক মেয়েকে অনেক যত্নে লালনপালন করেছেন। এমন মৃত্যু কল্পনা করতে পারছেন না।
লিপুর বন্ধু ফারজানা গাজী জানান, চার ভাইবোনের মধ্যে লিপু ছিল ছোট। স্রোত ইন্টেরিয়র অ্যান্ড ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন লিপু। বন্ধুদের বিপদ শুনলেই ছুটে যেতেন তিনি। ইরার এক ভাই কুয়েটে পড়াশোনা করছেন। তাদের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে।
গতকাল সরেজমিন রাজধানীর মধ্য মনিপুরে গিয়ে দেখা যায়, ৫৩৩/১ নম্বর বাড়ির আশপাশে শত শত শোকার্ত মানুষের জটলা। বাড়ির ভেতর পা ফেলার ঠাঁই নেই। দুটি মৃতদেহ পাশাপাশি গোসল করানো হচ্ছিল। প্রতিবেশীরাও জড়ো হয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.