ত্রিমুখী লড়াইয়ে তৈমুর চাঙ্গা by লোটন একরাম ও নিয়াজ মোর্শেদ

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ত্রিমুখী লড়াইয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার। বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের তিন নেতা শামীম ওসমানকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পর গতকাল শুক্রবার দলের অপর নেত্রী ও সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীও নির্বাচনে লড়ে যাওয়ার পাল্টা ঘোষণা দেওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচনী মাঠে নতুন মেরুকরণে বেশ ফুরফুরে মেজাজে রয়েছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীসহ চারদলীয় জোটের সর্বস্তরের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। নতুন করে আশাবাদী হয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন নিষ্ক্রিয় নেতাকর্মীরাও।


বিএনপির উজ্জীবিত নেতাকর্মীরা গতকাল গভীর রাত পর্যন্ত ব্যাপক গণসংযোগ ও প্রচারণাচালিয়েছেন।এ পরিস্থিতিতে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনকে নিয়ে নড়েচড়ে বসেছেন বিএনপি হাইকমান্ডও। প্রথমদিকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও গতকাল থেকে নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন তারা। নীতিনির্ধারক নেতারা মনে করেন, আওয়ামী লীগের দুই নেতা নির্বাচনী মাঠে থাকলে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর বিজয়ী হওয়া অনেকটা সহজ হবে। নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে শিগগির কেন্দ্রীয় নেতাদের নারায়ণগঞ্জ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন গতকাল সমকালকে বলেন, মহাজোট সরকার পৌনে তিন বছরের শাসনামলে দেশ পরিচালনায় সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুই নেতা নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনে বিএনপির সমর্থিত প্রার্থীর বিজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে বলে মনে করেন তিনি।
নবগঠিত সিটি নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী সমর্থন দেওয়াকে কেন্দ্র করে কার্যত এখন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ। নেতাকর্মীদের একটি অংশ দলসমর্থিত মেয়র প্রার্থী শামীম ওসমানের পক্ষে রয়েছেন। আবার নেতাকর্মীদের আরেকটি বড় অংশ আইভী রহমানের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। শামীম ওসমান গতকাল সমকালকে বলেছেন, 'দল তাকে সমর্থন দিচ্ছে তা আগেই জানতেন আইভী। নির্বাচন কমিশনের বাধ্যবাধকতার কারণে দল সমর্থনের বিষয়টি প্রকাশ্যে জানাতে পারেননি। তিন সাংগঠনিক সম্পাদকের মাধ্যমে নেতাকর্মী ও ভোটারদের জানানো হয়েছে।' অন্যদিকে সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেছেন, 'নির্বাচন থেকে তাকে এক চুলও নড়ানো যাবে না। কয়েকজন রাজনৈতিক বন্ধুর সমর্থন কোনোভাবেই দলীয় সমর্থন হতে পারে না।' অবশ্য বিকেলে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, দল এখনও কাউকে সমর্থন দেয়নি। এ বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
দু'জনকেই স্বাগত : তৈমুর আলম : শামীম ওসমান এবং ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী উভয়কেই ভোটের ময়দানে স্বাগত জানিয়েছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিকপন্থা অব্যাহত রাখতে তারা উভয়ই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
শামীম ওসমানকে আওয়ামী লীগের সমর্থন প্রশ্নে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে জানতে চাইলে তৈমুর আলম বলেন, এটা তাদের দলীয় ব্যাপার। আমি এটুকু বলতে পারি, গত পৌনে ৩ বছর বর্তমান সরকার নারায়ণগঞ্জের উন্নয়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তার ওপর গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের পাশাপাশি নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখীর কারণে সাধারণ মানুষ বিএনপিকে ভোট দিতে মুখিয়ে রয়েছে। ফলে সব দিক বিবেচনায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে তিনি এগিয়ে আছেন।
তৈমুর আলম দাবি করেন, আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থী নির্বাচন করায় তিনি অবশ্যই এগিয়ে থাকবেন। এছাড়া সরকারের অন্যসব ব্যর্থতার কারণে ভোটাররা তার পক্ষে রায় দেবেন। তিনি দাবি করেন, তিনি গণসংযোগে যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই ভোটারদের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পাচ্ছেন।
নড়েচড়ে বসেছেন কেন্দ্রীয় নেতারা : নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা নড়েচড়ে বসেছেন। প্রথম দিকে দলের শক্তিশালী প্রার্থী না থাকা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, প্রার্থীর নেতিবাচক দিকগুলোর কারণে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে আশাবাদী ছিলেন না দলের হাইকমান্ড। আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে থাকার ঘোষণা দেওয়ায় দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ নীতিনির্ধারকরা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। সার্বক্ষণিকভাবে নির্বাচনী এলাকায় খোঁজখবর রেখে কোনো সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন খালেদা জিয়া।
বিএনপির নীতিনির্ধারক নেতারা মনে করেন, ভোটারদের কাছে শামীম ওসমানের নেতিবাচক পরিচিতি রয়েছে। আওয়ামী লীগ তাকেই সমর্থন দিয়েছে। তারা বলেন, সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী অনেক বেশি জনপ্রিয়। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ভোট দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। একইসঙ্গে সাবেক সাংসদ আবুল কালামের সঙ্গে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তৈমুর আলমের দ্বন্দ্বও মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর বিজয় হওয়ার পথ অনেকটা প্রশস্ত হয়ে গেছে বলে দলীয় নেতারা মনে করেন।
নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন নিয়ে বিএনপির ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এ নির্বাচনে দলীয়ভাবে কোনো প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়ার সুযোগ নেই। এ নিয়ে কথাও বলতে চান না তিনি।
নতুন হিসাব-নিকাশ : নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট ৪ লাখ ৪ হাজার ১৮৯ ভোটার রয়েছেন। এর মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জে ১ লাখ ৪৪ হাজার, শহরে ১ লাখ ৬২ হাজার এবং বন্দরে ৯৭ হাজার ভোট রয়েছে। সিদ্ধিরগঞ্জে বিএনপির সাবেক সাংসদ মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন এবং শহর-বন্দরে সাবেক সাংসদ আবুল কালামের রিজার্ভ ভোট রয়েছে। ফলে এ দুই সাবেক সাংসদ তৈমুরের পক্ষে গণসংযোগে নামায় তা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে বলে জানিয়েছেন বিএনপি নেতা জান্নাতুল ফেরদৌস।
শহর বিএনপি সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম জানান, বিএনপি একটি বড় দল। এ দলের নিজস্ব ভোট রয়েছে। রয়েছে জামায়াতে ইসলামীর ভোটও। ফলে আওয়ামী লীগ থেকে দু'জন প্রার্থী থাকায় তাদের ভোট দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে আমাদের বিজয়কে সুনিশ্চিত করবে।
এ ক্ষেত্রে যুক্তি তুলে ধরে শহর বিএনপি একাংশের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, ২০০৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র ২৪ দিন পর অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ সদর এবং বন্দর উপজেলায় বিএনপি প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। কারণ সদর এবং বন্দর এলাকায় আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। ফলে ওই ২ উপজেলায় বিএনপি প্রার্থীদের জয় সহজ হয়েছিল। যদিও বিএনপি প্রার্থীর ভোট আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থীর সম্মিলিত ভোটের চেয়ে অনেক কম ছিল। এ অবস্থা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
নারায়ণগঞ্জ শহর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামাল জানান, যেহেতু আওয়ামী লীগের ২ প্রার্থী মাঠে রয়েছেন এবং তারা উভয়েই হেভিওয়েট, তাই আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। ফলে বিএনপি প্রার্থীর জয়টা এখন সহজ হয়ে গেছে।
জেলা শ্রমিক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু আল ইউসুফ খান টিপু জানান, বিগত দিনে আওয়ামী লীগ নারায়ণগঞ্জের জন্য কোনো উন্নয়ন করেনি। তাছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে যে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে তার জবাব দেওয়ার জন্য সাধারণ ভোটাররা অপেক্ষা করে আছেন।
ইসির প্রতি তৈমুরের অভিযোগ : এদিকে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে তৈমুর আলম বলেছেন, তিনি যেখানেই গণসংযোগ করতে যাচ্ছেন সেখানেই নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা উপস্থিত হয়ে বলছেন এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না। অথচ অন্য দুই প্রার্থীর ব্যাপারে এ সব নিয়ম-কানুনের বালাই নেই। তিনি বলেন, তিনি যেখানেই যান ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার কাছে এলে তিনি তাদের দূরে সরিয়ে দিতে পারেন না। তিনি নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, তাদের নিরপেক্ষ থাকতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.