ঝড়ে গৃহহীনদের চরম দুর্ভোগ

নোয়াখালী ও ভোলায় বুধবার রাতের ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বেশির ভাগ মানুষ গতকাল শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত ত্রাণ পায়নি। এই দুই জেলার গৃহহীন হাজার হাজার মানুষ মানবেতর দিন কাটাচ্ছে।প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, নোয়াখালীর সুবর্ণচরে এক হাজার ৪৮০ ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় এক হাজার ঘরবাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে।


এসব পরিবারের বেশির ভাগই গতকাল পর্যন্ত ত্রাণ পায়নি। ফলে তাদের দুর্ভোগ বেড়েছে। তারা প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে খেয়ে না-খেয়ে দিনাতিপাত করছে।
নোয়াখালীর হাতিয়ায় ৭৫টি মাছ ধরার নৌকা নিখোঁজ রয়েছে। একমাত্র সি-ট্রাক ডুবে যাওয়ায় ভোলার মনপুরা উপজেলা যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
গত বুধবার গভীর রাতে নোয়াখালী, ভোলা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় আঘাত হানা আকস্মিক ঝড়ে ২১ জনের মৃত্যু হয়। নিখোঁজ হয় প্রায় আড়াই হাজার মানুষ। সাড়ে ১৩ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়।
প্রথম আলোর আঞ্চলিক কার্যালয় ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
নোয়াখালী: জেলার সুবর্ণচর উপজেলার চর উড়িয়া, চর বায়োজিদের বহু লোক গতকাল বিকেল পর্যন্ত ত্রাণ পায়নি। কয়েকজন অভিযোগ করেন, স্থানীয় চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যরা তাঁদের নিজেদের লোকজন ও মুখচেনাদের দেখে দেখে তালিকা করছেন। চরক্লার্ক ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. শাহাবুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ইউনিয়নের সাত শতাধিক পরিবার সম্পূর্ণরূপে গৃহহারা। সরকারি বরাদ্দ থেকে ২০০ পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হচ্ছে।
তবে চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন নিজস্ব লোকজনকে ত্রাণ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন।
সুবর্ণচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খালিদ মেহেদী হাসান জানান, নিখোঁজ চারজনের একজন ফিরে এসেছেন। গতকাল সকালে মো. মামুন (২৮) নামের একজনের লাশ জেলেরা উদ্ধার করেছেন। তিনি উপজেলার চরবাটা ইউনিয়নের চরমজিদ গ্রামের আবদুল হকের ছেলে।
সরকারি হিসাবে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় প্রায় দুই হাজার পরিবার ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সেখানে গতকাল বিকেল পর্যন্ত ত্রাণ বিতরণ করা হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত করছে। ইউএনও আবদুল আউয়াল বলেন, বৃহস্পতিবার ত্রাণ বরাদ্দ পাওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকা করতে সময় লেগেছে। চেয়ারম্যানদের শুক্রবার ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা শনিবার (আজ) বিলি শুরু করবেন।
জেলা প্রশাসক মো. সিরাজুল ইসলাম গতকাল বিকেলে জানান, জেলার হাতিয়া, সুবর্ণচর ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য এ পর্যন্ত ১৬৫ মেট্রিক টন চাল, নগদ সাত লাখ ৬০ হাজার টাকা ও ৪০০ বান্ডিল ঢেউটিন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
সব এলাকায় ত্রাণসামগ্রী না পৌঁছানো প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক প্রথম আলোকে বলেন, একসঙ্গে সব ত্রাণসামগ্রী বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সঠিক তালিকা তৈরিতে সময় লাগছে। তবে শুক্রবার বিকেল নাগাদ সব এলাকায় বিশেষ করে চাল বিতরণ শুরু হওয়ার কথা। এ ছাড়া ব্যাংক বন্ধ থাকায় বরাদ্দ করা টাকা এখনো তোলা সম্ভব হয়নি।
হাতিয়া (নোয়াখালী): মেঘনা ও বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যাওয়া ৭৫টি ট্রলার ঝড়ের কবলে পড়ে গতকাল সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত নিখোঁজ ছিল। এসব ট্রলারের প্রায় প্রতিটিতে সাত-আটজন জেলে ছিলেন। গতকাল বিভিন্ন মাছঘাটের জেলেরা এ তথ্য জানান। তমরদ্দি বাজারের মাছ ব্যবসায়ী শাহাবউদ্দিন জানান, তিনি ও অন্যরা গতকাল দুপুরে তমরদ্দি ঘাটের পাশে মেঘনায় ছয়টি লাশ ভেসে যেতে দেখেছেন। ঝড়ে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত হাতিয়ায় সাতজন মারা যাওয়ার খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে।
জেলা প্রশাসন থেকে ঝড়ে নিহত ব্যক্তিদের জন্য পরিবারপ্রতি ১০ হাজার টাকা, ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অন্য ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য প্রাথমিকভাবে ৫০ মেট্রিক টন চাল এবং নগদ আড়াই লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ইউএনও মাহিদুর রহমান গতকাল জানান, দ্রুত ত্রাণসামগ্রী বিতরণের প্রক্রিয়া চলছে।
ভোলা: ঝড়ে তজুমদ্দিন-মনপুরা নৌপথে চলাচলকারী সি-ট্রাকটি ডুবে যাওয়ায় ভোলার মনপুরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মনপুরা ইউনিয়নের ঢালচরে মোস্তফা মাঝির ছোট মেয়ে ফাতেমা বেগম (১২ দিন) ঘর চাপা পড়ে মারা গেছে বলে গতকাল খবর পাওয়া গেছে। এ নিয়ে মনপুরা ও চরফ্যাশন উপজেলায় ঝড়ে মৃতের সংখ্যা ছয়জনে দাঁড়াল। ঝড়ের কবলে পড়া অনেক জেলে বিধ্বস্ত অবস্থায় ফিরে আসছেন। তাঁরা বিভিন্ন চরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ভোলার বিভিন্ন উপজেলায় দুই শতাধিক জেলে নিখোঁজ রয়েছেন। গতকাল বেলা তিনটা পর্যন্ত সি-ট্রাকটি উদ্ধার হয়নি। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) বরিশাল বিভাগীয় ব্যবস্থাপক গোপাল মজুমদার গতকাল বলেন, ‘উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা রওনা হয়ে গেছে। আজই (শুক্রবার) সি-ট্রাকটি উদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু হবে।’
মনপুরার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অহিদুল ইসলাম জানান, মনপুরায় ৩০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার তিন লাখ টাকার মতো বিতরণ করা হয়েছে। আজ চাল বিতরণ করা হবে। তিনি আরও জানান, মনপুরায় দুই হাজার পরিবারের ১০ কোটি টাকার মতো সম্পদ নষ্ট হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.