যথাসময়ে বিচার পাচ্ছেন না by রুবেল খান

গ্রামের সহজ-সরল মেয়ে শারমিন আক্তার। অল্প বয়সেই বিয়ে হয় তার। এক ছেলে সন্তানের জননী তিনি। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১০ সালে দরিদ্র বাবার অভাব-অনটনের সংসারে আশ্রয় নেন শারমিন। এরপর স্বামীর বিরুদ্ধে তিনি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন।


ওই মামলায় ওয়ারেন্ট জারি হওয়ায় স্বামী বিদেশে পালিয়ে যায়। এ অবস্থায় গত বছর বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের আইনি সহায়তায় মোহরানা, খোরপোশ ও সন্তানের আইনগত প্রাপ্য খোরপোশের দাবিতে চট্টগ্রামের পারিবারিক আদালতে মামলা করেন। কিন্তু পারিবারিক আদালতে বিচারক সংকটসহ নানা কারণে এখনও বিচার পাননি তিনি। অথচ পারিবারিক মামলা সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যেই নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। কিন্তু ছয় মাসের জায়গায় বছর পার হয়ে গেলেও বিচার পাননি শারমিন। যথাসময়ে বিচার না পেয়ে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তাকে। কারণ অর্ধ শতাধিক কিলোমিটার দূরে সাতকানিয়া থেকে চট্টগ্রাম নগরীর পারিবারিক আদালতে এসে তাকে মামলাটি পরিচালনা করতে হচ্ছে। কখন মামলাটি নিষ্পত্তি হবে তা জানা নেই তার। মামলা করেও সময়মতো বিচার না পেয়ে খুবই হতাশ শারমিন আক্তার। এ অবস্থায় মামলাটি চালিয়ে নেওয়ার আগ্রহও হারিয়ে ফেলেছেন তিনি।
পারিবারিক আইনের বিধান অনুযায়ী মামলার শুনানি সমাপ্ত হওয়ার পর এক সপ্তাহের মধ্যে রায় ও পরবর্তী এক সপ্তাহের মধ্যে ডিক্রি প্রচার করার নিয়ম। কিন্তু বাদী সাবিহা শরীফ পারিবারিক আদালতে প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পর মোহরানা ও খোরপোশের মামলা করলে তা গত আগস্টে একতরফা শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানি শেষ হওয়ার পর এখনও পর্যন্ত মামলার রায় প্রচার হয়নি। সাবিহা আবার বিয়ে করেছেন। দুগ্ধপোষ্য সন্তানের জননী তিনি। কখন মামলার রায় পাবে এবং কখন তার আইনগত প্রাপ্যগুলো আদায় করতে পারবেন তা নিয়ে আশাহত হচ্ছেন সাবিহা ও তার অভিভাবকরা। পারিবারিক আদালতে প্রায় ৫০ শতাংশ মামলা প্রি-ট্রায়ালের মাধ্যমে অর্থাৎ বিচার-পূর্ব শুনানি করে বিচারকের মধ্যস্থতায় মামলা নিষ্পত্তি করা হয়। এভাবে প্রি-ট্রায়ালের মাধ্যমে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি হলে বিচারপ্রার্থী নারীদের বছরের পর বছর আদালত প্রাঙ্গণে ঘুরতে হয় না। এতে অর্থ, সময় ও স্বাস্থ্যহানি হ্রাস পায়, বিশেষ করে হয়রানি ও ভোগান্তি অনেক কমে যায়। কিন্তু চট্টগ্রাম পারিবারিক আদালতে নিয়মিত এবং নিজস্ব বিচারক না থাকায় এ সুফল পাচ্ছেন না চট্টগ্রামের বিচারপ্রার্থী নারীরা।
জানা যায়, মোহরানা, খোরপোশ, দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার, বিবাহ বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত এই পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিচার নিষ্পত্তির জন্য ১৯৮৫ সালে পরিবার আদালত অধ্যাদেশের মাধ্যমে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় পৃথক পারিবারিক আদালত। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব বাংলাদেশি নাগরিকের পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য এ আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু শুরু থেকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিচারালয় চট্টগ্রামে পৃথক দুটি পারিবারিক আদালত থাকলেও সেখানে নেই নিজস্ব বিচারক। জন্মলগ্ন থেকে অর্থাৎ গত ২৭ বছর ধরে এই দুই পারিবারিক আদালতে নিজস্ব বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। অন্য আদালতের বিচারকদের অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে এই দুই পারিবারিক আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু ওই বিচারকরা তাদের আদালতের কার্যক্রম শেষ করে পারিবারিক আদালতের কার্যক্রম চালিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছেন। এ কারণে অধিকাংশ সময় পারিবারিক আদালতে মামলার শুনানি হচ্ছে না। এ কারণে যথাসময়ে বিচার পাচ্ছেন না চট্টগ্রামের ভুক্তভোগী নারীরা। একই কারণে বিকল্প পদ্ধতিতে অর্থাৎ প্রি-ট্রায়ালের মাধ্যমে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির সুফলও পাচ্ছেন না তারা। বর্তমানে পারিবারিক আদালতে বিচারাধীন পারিবারিক মামলার সংখ্যা দুই হাজার ২৭৭টি। আরও ৬০টি পারিবারিক আপিল মামলা বেশ কিছুদিন ধরে শুনানির অপেক্ষায় আছে। এভাবে দিন দিন মামলার স্তূপ হচ্ছে পারিবারিক আদালত দুটিতে।
যথাসময়ে বিচার পাওয়া নিশ্চিত করতে পারিবারিক আদালতের জন্য অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নিজস্ব বিচারক নিয়োগ অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট জিয়া হবীব আহসান ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শরীফ উদ্দিন। এ প্রসঙ্গে তারা বলেন, চট্টগ্রামে শুরু থেকে আজ পর্যন্ত দুটি পারিবারিক আদালতে বিচারক শূন্যতা বিরাজ করছে। এসব আদালত চালানো হচ্ছে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে পাঁচটি সিনিয়র সহকারী জজ আদালতকে দিয়ে। ফলে পারিবারিক আদালতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিষ্পত্তির জন্য সিনিয়র সহকারী জজগণকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই পারিবারিক আদালতের জন্য অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নিজস্ব বিচারক নিয়োগ অত্যন্ত জরুরি।
 

No comments

Powered by Blogger.