বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৩৯ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ সিরাজুল হক
বীর প্রতীক নকশী বিওপির যুদ্ধে শহীদ হন তিনি ১৯৭১ সালের ৪ আগস্ট শেরপুর জেলার নকশী বিওপিতে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে ভয়াবহ এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়।


মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নকশী বিওপি দুর্গের আদলে সুসজ্জিত করেছিল। এখানে মোতায়েন ছিল প্রায় একদল সুপ্রশিক্ষিত পাকিস্তানি সেনা।
মূল আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর দুটি কোম্পানি (ব্রাভো ও ডেলটা) অংশ নেয়। একটি দলে ছিলেন সিরাজুল হক। তাঁর দলে তিনিসহ মাত্র কয়েকজন ছিলেন নিয়মিত বাহিনীর মতো প্রশিক্ষিত। বাকিরা ছিলেন স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। যুদ্ধের পূর্ব অভিজ্ঞতা তাঁদের ছিল না। ওই যুদ্ধই ছিল তাঁদের জীবনের প্রথম যুদ্ধ।
এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণকারী দলের নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরী (বীর বিক্রম, পরে মেজর জেনারেল ও রাষ্ট্রদূত)। তাঁর বয়ানে শোনা যাক সেদিনের কিছু ঘটনা।
‘৩ আগস্ট রাতে (তখন ঘড়ির সময় অনুযায়ী ৪ আগস্ট) আমি দুই কোম্পানি যোদ্ধা নিয়ে নকশী বিওপি আক্রমণ করি। অ্যাসেম্বলি এরিয়া থেকে যোদ্ধারা অত্যন্ত সাবলীল গতিতে এফইউপিতে (ফর্মিং আপ প্লেস) রওনা হয়। মাঝপথে নালা ক্রস করার সময় তারা কোনো শব্দ করেনি। এর আগে যোদ্ধাদের নিয়ে পানির মধ্যে বিনা শব্দে চলার প্র্যাকটিস করেছিলাম।
‘তিনটা ৪৫ মিনিটে আমাদের আর্টিলারি গর্জে ওঠে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, যুদ্ধের আগেই এফইউপিতে নিজেদের আর্টিলারির কয়েকটি গোলা এসে পড়ে। একই সময়ে পাকিস্তানি আর্টিলারিও গর্জে ওঠে। এর মধ্যেই আমরা এক্সটেনডেড ফরমেশন তৈরি করি।
‘একটু পর অ্যাসল্ট লাইন ফর্ম করে আমি চার্জ বলে হুংকার দেওয়ামাত্র মুক্তিযোদ্ধারা সঙ্গিন উঁচু করে ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে যায়। শত্রু পাকিস্তানি সেনাদের বেয়নেট চার্জের জন্য তারা রীতিমতো দৌড়াতে থাকে। আমাদের মনোবল দেখে পাকিস্তানি সেনারা তখন পলায়নরত।
‘ঠিক তখনই শত্রুর আর্টিলারির শেলভো ফায়ার (এয়ার ব্রাস্ট) এসে পড়ে আমাদের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এতে মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আমার ডান পায়েও একটা শেল লাগে। শত্রুর বাংকার তখন কয়েক গজ দূরে।
‘দেখতে পেলাম, গুটি কতক অতি সাহসী মুক্তিযোদ্ধা পলায়নরত শত্রু পাকিস্তানি সেনাদের মারছে। কেউ কেউ মাইন ফিল্ডে ফেঁসে গিয়ে উড়ে যাচ্ছে। কেউবা শত্রুর গুলি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে। আমি তাদের মন চাঙা রাখার জন্য জোরে জয়বাংলা চিৎকার দিয়ে বললাম, আগে অগ্রসর হও। এরপর পাকিস্তানিদের বিওপি তছনছ হয়ে গেল।...’
সেদিন যুদ্ধে অবশ্য মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হতে পারেননি। সিরাজুল ইসলাম হাতাহাতি যুদ্ধের একপর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হন। বিদীর্ণ হয়ে যায় তাঁর শরীর। শহীদ হন তিনি। সহযোদ্ধারা তাঁর মরদেহ উদ্ধার করতে সক্ষম হন। তাঁকে ভারতের মাটিতে আরও কয়েকজনের সঙ্গে সমাহিত করা হয়।
শহীদ সিরাজুল হক চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। তাঁর পদবি ছিল নায়েক। ১৯৭১ সালে এর অবস্থান ছিল চট্টগ্রামের ষোলশহরে। তবে তিনি কয়েকজনসহ তখন চট্টগ্রামের একটি জুট মিলের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। ১ নম্বর সেক্টরের হরিনা ক্যাম্পে থাকাকালে তিনি মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সে অন্তর্ভুক্ত হন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ সিরাজুল হককে মরণোত্তর বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১১১।
শহীদ সিরাজুল হকের পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলার (ডাক ছোট কমলদা) ওয়াহেদপুর গ্রামে। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম সামসুল হক ভূঁইয়া, মা ঝিরাদন বিবি।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.