স্মরণ-অন্য রকম এক গুণীজন by নার্গিস হোসনে আরা

একেবারেই অন্য রকম একজন মানুষ ছিলেন তিনি। এক শতাব্দীর অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়েও ছিলেন একেবারে সাদাসিধে। অনেক গুণের অধিকারী হয়েও ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন একেবারে নিরহংকার। তাঁকে দেখলে, তাঁর সঙ্গে কথা বললে, নতুন কারো বুঝে ওঠা কঠিন ছিল যে- এই মানুষটির মধ্যে লুকিয়ে আছে এত প্রতিভা।


জন্মেছিলেন বাংলাদেশের ফেনী জেলায়। কিন্তু তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন উপমহাদেশজুড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন ও মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছিলেন। এর পর আর দশজন বাঙালি সন্তানের মতোই যোগ দিয়েছিলেন সরকারি চাকরিতে। কিন্তু বেশি দিন নিয়মবাঁধা সরকারি চাকরিতে মন বসেনি তাঁর। চাকরিতে ইস্তফা দিলেন। ১৯৪৪ সালে যুক্ত হলেন চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুর্ভিক্ষে বাংলার প্রায় ৫০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। সেই দুর্ভিক্ষের পটভূমিতেই তিনি নির্মাণ করলেন তাঁর কালজয়ী চলচ্চিত্র 'দুঃখে যাদের জীবন গড়া'। ছবিটি মুক্তি পেল ১৯৪৬ সালে। ওই সময় ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমান কোনো চলচ্চিত্রকারের চলচ্চিত্র নির্মাণ করাটা ছিল খুবই দুরূহ ব্যাপার। ওবায়েদ উল হক সেই ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তবে, সেই ছবিতে নিজের নামটি ব্যবহার করতে পারেননি। চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে তাঁর অভিষেক হিমাদ্রী চৌধুরী নামে। তাঁর ওই ছবির গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন প্রয়াত হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী বেলা মুখোপাধ্যায়। এরপর ওবায়েদ উল হক নির্মাণ করেন আরো দুটি চলচ্চিত্র- দুই দিগন্ত ও অন্তরঙ্গ। ষাটের দশকে তাঁর কাহিনী নিয়ে আজান নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন মরহুম ফজলুল হক।
দেশ বিভাগের পর কলকাতা ছেড়ে বাংলাদেশে চলে আসেন তিনি। ১৯৫১ সালে যোগ দেন ওই সময়ের ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভারের সম্পাদকীয় বিভাগে। অবজারভারের সহকারী সম্পাদক, উপসম্পাদক, যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন অবজারভারের সম্পাদক। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট গঠনের সময় তিনি প্রতিষ্ঠানটির গঠন কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। প্রেস ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেছেন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। দৈনিক বাংলা ও বাংলাদেশ টাইমস ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেছেন। ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের আপীল কমিটির চেয়ারম্যানও ছিলেন। নজরুল ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেছেন। সাংবাদিকতা পেশা থেকে অবসর নেওয়ার পর সংবাদপত্রে নিয়মিত কলাম লিখেছেন। লিখেছেন রম্য রচনা। তাঁর লেখার ভেতর দিয়ে সমাজ বাস্তবতার সঠিক চিত্রটিই ফুটে উঠত।
ওবায়েদ উল হক সত্যিকারের এক সব্যসাচী লেখক। সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। পেশার লেখার পাশাপাশি লিখেছেন গল্প, কবিতা, উপন্যাস, রম্য রচনা ও নাটক। তাঁর নাটকের বই 'এই পার্কে', 'দিগ্বিজয়ী চোরাবাজার' ও 'সমাচার এই'। প্রকাশিত উপন্যাস 'ঢল'। কবিতার বই 'গরীব হতে চাই' ও 'পথের পদাবলী'। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর রম্য রচনার বই 'বাণপ্রস্থের পর'। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক। পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পুরস্কার, মার্কেন্টাইল ব্যাংক সম্মাননা, ইউনিসেফ পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। বনানীর বাড়িতে পড়াশোনা করেই শেষ দিনগুলো কেটেছে তাঁর। অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী মানুষটি ২০০৭ সালের ১৩ অক্টোবর ইহলোকের মায়া কাটিয়ে চলে যান।
আজ তাঁর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে আমাদের শ্রদ্ধা।
নার্গিস হোসনে আরা

No comments

Powered by Blogger.