সংঘাত- মিয়ানমারের জাতিদ্বন্দ্ব ও যুক্তরাষ্ট্র by টিম হেইনমান

যুদ্ধোত্তর ইরাক-আফগানিস্তানে বিস্তর কেলেঙ্কারির পর যুক্তরাষ্ট্র এখন মিয়ানমারের দিকে নজর ফেলেছে। বিপুল ধ্বংসের বিনিময়ে পাওয়া শিক্ষা এবার তারা ফলাতে যাচ্ছে এখানে। এই তিন দেশের মধ্যে এক ব্যাপারে অনেক মিল: তিনটি দেশই জাতিগত বৈচিত্র্যে একই সঙ্গে সমৃদ্ধ ও নাজুক।


সে জন্যই দরকার ছিল সব জাতির মর্যাদা ও ক্ষমতার ভারসাম্য। সে কারণেই যুক্তরাষ্ট্র যে খেলা এ অঞ্চলে খেলতে চাইছে, তার মানবিক জটিলতা ও কৌশলগত গুরুত্ব কি তারা বুঝতে পারছে?
চীনকে ভারত মহাসাগরে পৌঁছানোর বন্দোবস্ত করে দিয়ে মিয়ানমার যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ কেড়েছে। এ কারণেই মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের সঙ্গে যোগাযোগে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী। যদিও অনেক সমস্যা টিকে থাকায় মার্কিন কংগ্রেস কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবরোধ বজায় রেখেছে। প্রশ্ন হলো, এ অঞ্চলে টেকসই অগ্রগতির পথ যুক্তরাষ্ট্রের জানা আছে কি না। ইতিহাস বলে, বিভেদ-বৈচিত্র্যে ভরা সমাজে জাতিগত সমস্যা বুঝতে যুক্তরাষ্ট্র সর্বদাই ব্যর্থ হয়েছে। তারা ভিয়েতনাম ও সোমালিয়ার জনগণকে ভুলভাবে বুঝেছিল। এ দুটি দেশেই যুক্তরাষ্ট্র চালিয়েছিল সামরিক হস্তক্ষেপ। শীতল যুদ্ধকালীন কূটনীতির ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে কারবারে যতটা উৎসাহী, বাস্তব জমিনে মানুষের বেহাল অবস্থা আমলে নেওয়ায় ততটাই নারাজি। এই বিচারে ইরাক ও আফগানিস্তানের শিক্ষা আমাদের হুঁশিয়ার করে, উঠে দাঁড়াতে বলে। সেখানে প্রমাণিত হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার ও সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার তরিকা অকাজেরই হয়।
মিয়ানমারে নীতির বিপদ হলো, যুক্তরাষ্ট্র কেবল থেইন সেইন ও সু চিকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। বিপরীতে উপেক্ষিত হচ্ছে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলো, যেমন: চিন, কাচিন, কারেন ও শান। এসব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতি ইউরোপীয়দেরও মনোযোগ নেই। অথচ তারা কেবল ক্ষমতা-রহিতই নয়, নিষ্পেষিত ও সম্পদবঞ্চিত। গত ছয় দশকের টানা সামরিক শাসনে তারা এতই কোণঠাসা ছিল যে, তাদের পক্ষে বিশ্বের সামনে গুরুতর অনেক ঘটনা হাজির করা কঠিন।
সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের থেইন সেইনের সমঝোতা-প্রক্রিয়ায় বাধা হিসেবে দেখা না শুরু করে। এসব জনজাতিকে প্রতিনিধিত্ব করায় থেইন সেইন বা সু চির মতো মহিমাসম্পন্ন কোনো নেতাও নেই। এই প্রেক্ষাপটে যখন পশ্চিমা সরকারগুলো মিয়ানমারের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে, তখন জনজাতিগুলোর গুরুতর অবস্থা উপেক্ষিতই থাকছে।
প্রথমত, মিয়ানমারের বর্মি জাতি বিশ্বকে বোঝাতে সমর্থ হয়েছে যে অ-বর্মিরা সে দেশে সংখ্যালঘু। বাস্তবত অ-বর্মিরা সেখানকার জনসংখ্যার অর্ধেক। একসময় তারাই বংশানুক্রমে দেশটির বেশির ভাগ সীমান্ত এলাকা ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথের অধিকারী ছিল। মিয়ানমারের প্রাকৃতিক সম্পদের বেশির ভাগটাও তাদের হাতেই ছিল। পরিহাস হলো, এসব সম্পদের জোরেই অতীত ও বর্তমানের বর্মি শাসকেরা দেশটি শাসন করে আসছে।
একের পর এক নিপীড়ক সরকার ‘বৌদ্ধ মাত্রই বর্মি’, এমন ধারণা দিয়ে এসেছে। এর ফলে অ-বর্মিদের দাবিদাওয়াকে সংখ্যালঘুর সমস্যা হিসেবে দেখানো যাচ্ছে। তাই রাষ্ট্রের পক্ষেও জাতিগত সংগ্রামকে, ছোটখাটো সমস্যাকে জিইয়ে রাখার আন্দোলন এবং অ-বর্মিদের উন্নয়নের পথে বাধা বলে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, অ-বর্মি জাতিসত্তাগুলোই হলো একক বৃহত্তম জনপুঞ্জ। টেকসই শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য তাই তাদের সঙ্গেই যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা দরকার।
খেয়াল করার বিষয়, বর্মি সেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ে জাতিসত্তার প্রতিরোধের রেকর্ড অতুলনীয়। লড়াইয়ের ময়দানে একজন প্রতিরোধযোদ্ধার প্রাণের বদলায় গেছে ১০০ বর্মি সেনার প্রাণ। এটাই প্রমাণ করে, এসব মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের পরিবার, পূর্ব প্রজন্মের ভূমি ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্যই লড়াই করছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা তৃণমূল পর্যায়ের প্রতিরোধশক্তির পরিচয় মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভালো করেই পেয়েছে। পরিণামে হয়তো এই মানবিক প্রতিরোধই মিয়ানমার রাষ্ট্রের সামরিক শক্তি ও সমরসরঞ্জাম ছাপিয়ে টিকে থাকবে।
দ্বিতীয়ত, যুগ যুগ ধরে খনিসমৃদ্ধ জনজাতীয় এলাকা কেড়ে নেওয়ায় নিপীড়নের হাতিয়ার হলো বর্মিপ্রধান মিয়ানমারি সেনাবাহিনী। এখনো ১২০টি সেনা ব্যাটালিয়ন উত্তর মিয়ানমারের কাচিন এলাকায় হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এসব দেখেও না দেখার ভান করে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের সঙ্গে সামরিক-সামরিক যোগাযোগের রাস্তা খুলছে।
থেইন সেইনের নতুন সরকারের সঙ্গে দোস্তালি পাতাতে অধীর পশ্চিমা সরকারগুলো মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দিকে চোখ বুজে থাকছে। মাঠপর্যায়ে জেনারেলরা যে থেইন সেইনের কথা শোনেন না, সেটা পশ্চিমাদের জানা উচিত।
থেইন সেইন পশ্চিমা সরকারগুলোকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, জাতিগত সমঝোতা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার, এখন অবরোধ তুলে নিলে সেই সমঝোতায় এগোতে সুবিধা হবে মিয়ানমারের। সে কারণে কিছু রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হচ্ছে। অন্যদিকে, বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিকে কাজে লাগানো হচ্ছে সামরিক বাহিনীর হারানো অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য। অ-বর্মিদের জাতিগত ঐক্যে ফাটল ধরানোর জন্যও এই সময়টাকে তারা কাজে লাগাচ্ছে। এই ছলছুতোয় সু চির ভূমিকা হলো বর্মি-নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের প্রচারক ও বৈধতাদানকারীর। মিয়ানমারের কোনো নেতাকেই দেখা যায়নি জাতিগত সমস্যায় স্থায়ী ও পরিষ্কার অবস্থান নিতে।
এসব ধোঁকার আড়ালেই ঢেকে রাখা হয়েছে মিয়ানমারের সত্যিকার ইস্যু—সমতাভিত্তিক ভূমি সংস্কার। দলিত জাতিগোষ্ঠীর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া ভূমির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে মিয়ানমারের অর্থনীতি। এসব সমস্যার বিহিত না করে বিনা শর্তে অবরোধ তুলে নেওয়া মানে মিয়ানমারের বর্মীকরণকেই মদদ জোগানো। এতে মিয়ানমারের সংস্কারপন্থী ও সামরিক জান্তা উভয়েরই লাভ। এদের দ্বিগুণ লাভের দ্বিগুণ শিকার হচ্ছে কারেন, কাচিনসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলো। এদের প্রতি ভীতি ছড়ানোও শাসক জোটের কৌশল। কিন্তু টেকসই শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে এসব প্রশ্নের বিহিত করতেই হবে।
যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু উত্তরোত্তর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার খেলায় জড়িয়ে যাচ্ছে, সেহেতু এই ব্যাপারগুলো তাকে বুঝতেই হবে। আমরা এখন এমন এক যুগে বসবাস করছি, যখন ক্রমাগত হারতে থাকা মানুষ জিততে চাইছে। কোনো রাষ্ট্রই আর দীর্ঘকাল বড় জনগোষ্ঠীকে একতরফা মার দিয়ে পার পাবে না। উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সরকার বদলগুলো এরই ইঙ্গিত দেয়। মিয়ানমারেও এর ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীগুলো সেখানে সংখ্যালঘুও নয়, শক্তিহীনও নয়। ওয়াশিংটন যদি এখনই ভারসাম্যপূর্ণ নীতি না নেয়, তা হলে ভিয়েতনাম, ইরাক ও আফগানিস্তানে যা হয়েছে, এখানেও তার পুনরাবৃত্তি হবে। খেলার চাল বদলে যাবে।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
 টিম হেইনমান: অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

No comments

Powered by Blogger.