কারাগারে ডেসটিনির তিন কর্তা-গ্রাহক স্বার্থ সুরক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে

ডেসটিনি গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর। অনিয়ম তো আছেই, আছে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার, কর ফাঁকি এবং অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগ। এসব অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলায় আদালত ডেসটিনির তিন শীর্ষ কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন।


ডেসটিনির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়। গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি আট মাস পর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সে প্রতিবেদনে যে চিত্রটি উঠে এসেছে, তা অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর। এতে বলা হয়েছে, ডেসটিনির শীর্ষ কর্তারা এক হাজার ৪৫৪ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম করেছেন। দুই হাজার ৩৪৬ কোটি টাকার অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে। ডেসটিনিসহ এমএলএম ব্যবসা পরিচালনাকারী আরো অনেক কম্পানির বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে। অতীতেও অনেক কম্পানি রাতারাতি টাকা কামানোর প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে তাদের পথে বসিয়েছে। তবু এ ধরনের প্রতারণামূলক ব্যবসা ধরন ও কৌশল বদলিয়ে চলছে। অনেকে ডেসটিনির বিভিন্ন প্রকল্পে টাকা বিনিয়োগ করেছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে অল্প সময়ে অধিক লাভের সহজাত প্রবণতা আছে। এর পাশাপাশি কর্মসংস্থান ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ সংকুচিত হয়ে গেলে মানুষ বিনিয়োগের জায়গা খোঁজে। প্রয়োজন হয় বিশ্বাসযোগ্যতার। ডেসটিনি যেকোনোভাবেই হোক সেই বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করেছিল। তবে প্রতিষ্ঠানের ভেতরের অনিয়ম তো বাইরের কর্মী বা বিনিয়োগকারীর দেখার সুযোগ ছিল না। ডেসটিনি নামের প্রতিষ্ঠানটি দেশেই ব্যবসা করছে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার চোখের সামনেই তা করেছে। সেই ব্যবসা বৈধ নাকি অবৈধ, সেখানে কোনো অনিয়ম হচ্ছে কি না, এটা দেখার দায়িত্ব ছিল সরকারেরই একাধিক সংস্থার। এখন তদন্ত কমিটি তদন্ত করে প্রতিষ্ঠানটির নানা অনিয়ম ও অবৈধ কার্যকলাপ বের করেছে। এখন নিবিড় তদন্তের কথা বলা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, আগে কেন তদন্ত হলো না। দুদক, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, যৌথ মূলধনী কম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) এখন ডেসটিনির অনিয়ম-দুর্নীতি খতিয়ে দেখবে। যখন অনিয়ম হয়েছে, যখন ডেসটিনি শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে দেশব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে, তখনই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। আগে থেকেই কঠোর ব্যবস্থা নিলে সাধারণ মানুষ এভাবে প্রতারিত হতো না, পথে বসত না। এর দায় ও দায়িত্বটা সরকারের ওপরই বেশি বর্তায়। নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে 'হায় হায় কম্পানি' গড়ে ওঠার সুযোগ পায় না। দেশে যখন বেকারত্ব বাড়ে, ব্যবসায় মন্দা যায়, তখন সাধারণ মানুষ নিজেদের মতো করে বিনিয়োগের জায়গা খোঁজে। এই সুযোগ ডেসটিনিসহ অনেকেই নিয়েছে। এসব কম্পানির প্রতারণার শিকার হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। অনেক প্রতিষ্ঠান মানুষের কষ্টার্জিত সম্বলটুকু নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। আবার নতুন প্রতিষ্ঠান গজিয়েছে, এমন প্রমাণও তো রয়েছে।
ডেসটিনির শীর্ষ কর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তিন শীর্ষ কর্মকর্তা কারাগারে গেছেন। কিন্তু মানুষের বিনিয়োগের কী হবে? সরকারের পক্ষ থেকে এক বা একাধিক প্রশাসক নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। এই প্রশাসকের সার্বিক তত্ত্বাবধানে নিরীক্ষা পরিচালনা করা হবে। প্রশাসক ব্যাংক হিসাব নিয়ন্ত্রণসহ ডেসটিনির দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবেন। প্রশাসক ডেসটিনির কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়ে না আসা পর্যন্ত কাজ করবেন। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করা অর্থের সুরক্ষা কি এই প্রশাসক নিয়োগের ঘোষণায় নিশ্চিত হচ্ছে।
ডেসটিনির ব্যাপারে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভাবতে হবে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ। বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। একজন বিনিয়োগকারীও যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন তা নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যতে যেন আর কোনো কম্পানি ব্যবসার নামে প্রতারণা করতে না পারে সে জন্য কঠোর শাস্তির বিধান করে প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.