তুরস্কে টর্চার সেল, মুক্তিপণ আদায় বাংলাদেশে by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ

দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এখন বিদেশ বিভুঁইয়ে সক্রিয় বাংলাদেশী অপহরণকারী চক্র। তবে তারা ভিন্ন কৌশলে নেমেছে এ পথে। ইতালি আর গ্রীসে পাঠানোর নামে ওমান ও দুবাইয়ে কর্মরত বাংলাদেশীদের উদ্বুদ্ধ করতো। বেশি অর্থ উপার্জনের লোভে তারা পা দিতো অপহরণকারীদের খপ্পরে।

এর পরই তাদের নিয়ে শুরু হতো খেলা। দুবাই থেকে হেঁটে ইরান হয়ে তুরস্কে অপহরণকারীদের টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখান থেকে বাংলাদেশে স্বজনদের কাছ থেকে আদায় করা হতো মুক্তিপণ। মাইলের পর মাইল মরুভূমি পেরিয়ে স্বপ্ন নিয়ে সহজ সরল বাংলাদেশীরা ছুটতো। কিন্তু তখনও জানতো না তারা অপহরণকারী চক্রের খপ্পরে পড়েছে। তুরস্কে টর্চার সেলে যাওয়ার পরই তাদের মুখোশ খুলে যায়। শুরু হয় তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন। অব্যাহত প্রহার, উপরে তুলে নিচে ফেলে দেয়া। কখনও কখনও গরম পানি শরীরে ঢেলে নির্যাতন চালাতো। এসবের পেছনে কারণ একটাই মুক্তিপণ আদায়। তুরস্কের নির্যাতনে কান্নার শব্দ মোবাইল ফোনে বাংলাদেশে থাকা পরিবার পরিজনকে শুনাতো। বলা হতো এসব থেকে বাঁচতে হলে টাকা পাঠাও। এভাবে কোটি কোটি টাকা চক্রটি হাতিয়ে নিয়েছে। এ চক্রের হাতে সর্বস্ব খুইয়ে নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে গতকাল ৩৮ বাংলাদেশী দেশের মাটিতে পা রাখেন। বিমানবন্দরে স্বজনদের দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। তাদের কাছে এ যেন অবিশ্বাস্য। সাদেকুল তার হাত-পায়ের নির্যাতনের চিহ্ন দেখিয়ে কেঁদে ওঠেন। বলেন, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। কখনও ভাবিনি জালিমদের হাত থেকে রক্ষা পাবো। বুকভরা আশা নিয়ে এগারো মাস আগে ওমানে গিয়েছিলেন কুমিল্লার জালাল উদ্দিন। সেখানে খেয়ে পড়ে ভালই ছিল। ৫ মাস আগে সালাউদ্দিন ও সাইফুল নামে ২ বাংলাদেশী অপহরণকারীর খপ্পরে পড়েন তিনি। অল্প টাকায় গ্রিসে গিয়ে বেশি অর্থ উপার্জন করবেন। এ লোভ সামলাতে পারেননি। হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে দীর্ঘ ৪ মাস পাড়ি দেন দুর্গম পথ। সঙ্গে ছিল ভাগ্যবদলের স্বপ্ন দেখা আরও ৬৫ বাংলাদেশী। শেষে মুহূর্তে দলটি পৌঁছায় তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে। হেলিকপ্টার থেকে ওমান পুলিশের গুলিতে যাত্রপথে মারা যায় ২ সফরসঙ্গী। ঠাণ্ডায় মারা যায় আরও একজন। তাদের লাশ ফেলে দেয়া হয় সমুদ্রে। এরপর তুরস্কে একটি ঘরে তাদের আটকে রাখা হয়। যেটি তাদের টর্চার সেল। এ সময় মুক্তিপণের জন্য তাদের নির্যাতন শুরু করে চক্রটি। প্রিয় সন্তানকে বাঁচাতে কেউ বা স্বামী, কেউ বা ভাইকে বাঁচাতে সহায়-সম্বল বিক্রি করে দেশে নিযুক্ত অপহরণকারী চক্রের এজেন্টের হাতে তুলে দেয় লাখ লাখ টাকা। কেবল জালালের পরিবারের কাছ থেকেই চক্রটি হাতিয়ে নিয়েছে মুক্তিপণের ৭ লাখ টাকা। এভাবে ব্যক্তিবিশেষ ৪ থেকে ৯ লাখ টাকা নিয়েছে দালালরা। অবশেষে রুমের তালা ভেঙে পালিয়ে পুলিশের কাছে আশ্রয় নেয় সাদেকুল, জালাল, সবুজসহ ৩৮ বাংলাদেশী। তারপর পুলিশ এবং বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরেছেন কুমিল্লার জালাল, নরসিংদীর সাদেকুল ইসলাম, নোয়াখালীর রাজু, গাজীপুরের সবুজ, কিশোরগঞ্জের রানা। গতকাল ভোর পাঁচটায় তুর্কি টিকে-৭১২ এয়ার লাইন্সের একটি ফ্লাইটে তারা দেশে ফিরেন। বিমানবন্দরে লোমহর্ষক বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা। প্রত্যেকেই তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন ও পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণের টাকা আদায়ের। হৃদয়বিদারক বর্ণনা দেন। বাংলাদেশী এ চক্রের হাতে এখনও তুরস্কে কমপক্ষে ৬০০ বাংলাদেশী আটক রয়েছে বলে তারা অভিযোগ করেন। ইরান ও তুরস্কের স্থানীয় অধিবাসী এবং দেশ দুটির বর্ডার আর্মির সহায়তায় অপরাধীরা এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই আত্মীয়-স্বজন বিমানবন্দরে তাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। ইমিগ্রেশন থেকে তারা বের হলে বুকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা। অনিকের বাবা তথ্য-অধিদপ্তরের কর্মচারী ইসহাক মিয়া বলেন, ৫ মাস আসে গ্রামের বাড়ির জমি বিক্রি করে ছেলে অনিককে দুবাই পাঠাই। সেখানে যাওয়ার দেড় মাসের মাথায় হঠাৎ ছেলের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ১৪ দিন পর ইরান থেকে আমার কাছে একটি কল আসে। বাংলাদেশী এক অপহরণকারী আমাকে জানায়, অনিককে পেতে হলে ৭ দিনের মধ্যে ৩ লাখ টাকা দিতে হবে। ছেলেকে ফিরে পেতে আমরা তখন মরিয়া। কথা মতো, দেশের একটি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে কুমিল্লায় সুজন নামের এক এজেন্টের কাছে দুই লাখ টাকা পাঠাই। এ ঘটনার কিছুদিন পর আবার আমাকে ফোন করে অপহরণকারীরা। এবার অনিকের সঙ্গে কথা হয়। সে জানায়, তুরস্কে তাকে আটকে রাখা হয়েছে। কথা বলার সময়েই তাকে লোহার পাইপ দিয়ে পেটাতে থাকে। ছেলের কান্না শুনে আমি আবারও টাকা দিতে রাজি হই। এবার সিলেটে কবীর মাস্টারের কাছে একইভাবে পাঠাই আরও দুই লাখ টাকা। কিন্তু তবুও তারা অনিককে মুক্তি না দিলে আমি দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করি। কিছুদিন পর জানতে পারি, অনিকসহ প্রায় শতাধিক বাংলাদেশী ইমিগ্রেশনে আটকা রয়েছে। এরপর তুরস্কে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সহায়তায় অনিকসহ ৬৫ বাংলাদেশীকে ফিরেয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। শুনেছি, পুলিশের কাছে এখনও ৩০ জন আটক রয়েছে।
অনিক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, দুবাইতে নতুন আসা বাংলাদেশী তরুণরাই মূলত এদের প্রধান টার্গেট। গ্রিস ও ইতালি পাঠানোর ঘটনা বিশ্বাস করাতে ওখানকার অভিবাসী কাউকে দিয়ে ফোন করায় চক্রটি। টাকা আয়েরও ভাল ব্যবস্থা রয়েছে। যেতে কেমন টাকা লাগবে জানতে চাইলে, তারা জানায়, কোন টাকা লাগবে না। বেতনের অর্ধেক প্রতি মাসে দিলেই হবে। এভাবেই ওরা সবাইকে রাজি করায়। আমার দলে ৩৩ জন ছিল। প্রথমে আমাদের ওমানের রাজধানী মাসকটে নিয়ে যায়। দুজন দালাল আমাদের সঙ্গে ছিল। মাসকাট থেকে স্পিডবোটে করে ইরানের সমুদ্রের পাড়ে মিনহাব নামক একটি জঙ্গলে উঠায়। সমুদ্র যাত্রাপথে ওমানের পুলিশ হেলিকপ্টার থেকে আমাদের লক্ষ্য করে গুলি করে। এ সময় চাঁদপুর ও নোয়াখালীর দু’জন নিহত হয়। তাদের লাশ ফেলে দেয়া হয় সমুদ্রে।’ ‘ইরানের মিনহাব জঙ্গলে আমাদের ১৪ দিন আটকে রাখে। ওখানে ছোট ছোট দলে অনেক বাংলাদেশীই দুই সপ্তাহ থেকে ২ মাস আটকে থাকে। এ সময় আমাদের রান্না করে খাওয়ার জন্য চাল ও একটা করে আলু দেয়া হতো। দালালদের কাছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র দেখেছি। ফলে কেউ কোন প্রতিবাদ করতে পারে না। করলেই শুরু হয় নির্যাতন। এখান থেকে তেহরানের বান্দারিয়াতে নিয়ে যায়। সেখান থেকে ৪ রাত হেঁটে তুরস্কের কাছাকাছি তাব্রিজ নামক বর্ডারে নিয়ে যায়। আমরা দেখেছি ইরানের বর্ডারের আর্মিরাও এ চক্রের সঙ্গে জড়িত। তাদের সহায়তায় ইস্তাম্বুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অপহরণকারীদের জন্য বিভিন্ন বিল্ডিংয়ে ছোট ছোট রুম রয়েছে। এগুলোকে ওরা ‘সেফরুম’ বলে। এগুলোই ওদের টর্চার সেল। নোয়াখালীর শফিকুল ইসলাম জানান, প্রতিজনের জন্য কমপক্ষে ৮ লাখ টাকা আদায় করে তারা। টাকা নিয়ে ইস্তাম্বুলের রাস্তায় ছেড়ে দেয়। এক সময় পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে। মুক্তির বিষয়ে অনিক বলেন, একদিন চট্টগ্রামের এক বৃদ্ধকে সেফরুমে আমাদের সামনেই বেদম মারতে থাকে নোয়াখালীর চাটখিলের অপহরণকারী পারভেজ। এ সময় আমরা ১৭ জন প্রতিবাদ করলে আমাদেরও পেটায়। এ সময় আমরা সবাই মিলে পারভেজকে পিটিয়ে ঘরের তালা ভেঙে বেরিয়ে যাই। প্রায় দেড় ঘণ্টা দৌড়ানোর পর একটা পেট্রোল পাম্পে গিয়ে বিশ্রাম নেই। থানায় ১৬ দিন থাকার পর ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে আমাদের হস্তান্তর করা হয়। রাজু বলেন, ইস্তাবুলের তাসকিনে প্রায় ১ হাজারের মতো রুম আছে। যেখানে অপহরণের পর পাকিস্তানী ও বাংলাদেশীদের আটকে রাখা হয়। দালালদের বেশির ভাগই ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং সিলেটের। আমাদের যে দালাল আটকে রেখেছিল সে তুর্কিতে আহমেদ নামে পরিচিত। পরে জেনেছি তার আসল নাম শরীফ। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নয়নপুরে। তার বাবার নাম কবির মাস্টার। তারা জানান, তাদের কাছে কোন পার্সপোট ও ভিসা ছিল না। ওমান ও দুবাইতে যে কোম্পানিতে কাজ করতেন ওখানেই এগুলো রয়ে গেছে। তুরস্ক থেকে দেশে ফিরেছেন রাজু, জালাল উদ্দিন, সাদেকুল, সবুজ, আলমগীর,  জয়নাল আবেদিন,  মাজেদুল, ইব্রাহিম, লিটন, রানা, সুমন, ইউসুফ, মোতাহার, আবু বক্কর, হেদায়েতুল্লাহ, শফিকুল ইসলাম, বাপ্পী,  জাফর আলী, শামীম মিয়া, সোহেল, মুরাদ, সাইফুল, হাফিজুল, ডালিম হোসেন, সালাম মিয়া, সোহাগ, হানিফ, আবদুল আহাদসহ প্রতারণার শিকার মোট ৩৮ বাংলাদেশী। এর আগে গত মাসের ২৫শে সেপ্টেম্বর ২৭ জনের আরও একটি দল দেশে ফিরেছেন। ওআইএম (অর্গানাইজেশন ইন্টারন্যাশনাল ফর লেস মাইগ্রেশন) নামের একটি সংস্থা তাদের বিমান ভাড়াসহ হাত খরচ বাবদ আরও ২৫ ডলার দিয়েছে বলে তারা জানান। তুরস্কে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জুলফিকার রহমান, কনসালটেন্ট আশিকুল ইসলাম এবং রাষ্ট্রদূতের গাড়িচালক শওকতের সার্বিক সহায়তা  এবং তাদের সফরসঙ্গী ফয়সাল অনিকের বাবা বাংলাদেশে অবস্থানরত তথ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক ইসহাক মিয়ার সহায়তায় তারা দেশে ফিরতে সক্ষম হয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.