কর্তৃত্বের যথেচ্ছ প্রয়োগ by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

আক্ষরিক অর্থে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা এক মনে হলেও বাস্তবে তা এক নয়। কর্তৃত্বকে আইনগত অধিকার বা দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাধারণত বিভিন্ন পদে আসীন ব্যক্তিরা কর্তৃত্ব ভোগ করে থাকেন। এ ছাড়া উত্তরাধিকার আইন কিংবা জৈবিক সম্পর্কের মধ্যেও কর্তৃত্বের সংজ্ঞা লুক্কায়িত আছে।


সমাজ বা রাষ্ট্রে বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা আইনগতভাবে যে অধিকারগুলো ভোগ করেন, একে কর্তৃত্বের মধ্যে ফেলা যায়। জৈবিক সম্পর্কের মধ্যে সন্তানের প্রতি মা-বাবার অধিকার কর্তৃত্বের পর্যায়ভুক্ত। কর্তৃত্বের অনুশীলনে তেমন কোনো বাধা নেই। তবে যথেচ্ছ অনুশীলন কখনো কখনো আইন লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়ে, বিশেষ করে যখন তা নিয়ম-কানুনের মধ্যে না থাকে। আমরা সচরাচর কর্তৃত্ব প্রয়োগ ও অনুশীলন করি। এ কাজে আনন্দ থাকে, থাকে বেদনার চিহ্নও। সন্তানের অন্যায় আচরণে মা-বাবার কর্তৃত্ব প্রয়োগ কার্যত সঠিক মনে হলেও তাঁদের কাছে বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর ক্ষমতা একান্ত ব্যক্তিগত গুণাবলি, যার দ্বারা অন্যকে প্রভাবিত করা যায়। ব্যক্তির নিজস্ব গুণাবলির বহিঃপ্রকাশ মূলত ক্ষমতা। সেই গুণাবলির সঠিক ও উপযুক্ত প্রয়োগ কল্যাণকর। কিন্তু অনুপযুক্ত ক্ষমতার প্রয়োগ কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণ বয়ে আনে। কারো কর্তৃত্ব না-ও থাকতে পারে; কিন্তু ক্ষমতার জোরে ইতিবাচক ফল বয়ে আনে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনেক কর্তৃত্ব ছিল না; কিন্তু ছিল অফুরন্ত ক্ষমতা, যার জোরে তিনি বিশাল জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন বিধায় আপামর জনসাধারণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। তাঁর ক্ষমতার জোরেই এটি সম্ভব হয়েছিল।
সরকারের বিভিন্ন পদে থাকা ব্যক্তিদের কর্তৃত্ব থাকে; কিন্তু কখনো কখনো তাঁরা কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়েন। কারণ হলো, কর্তৃত্ব না বুঝে প্রয়োগ করা। আর তাঁদের ক্ষমতার দৌরাত্ম্য এতটাই বেশি যে 'দিস ইজ নট ইওর বিজনেস'- এখানে বিজনেস অর্থে 'ব্যবসাকে' বোঝেন। ক্ষমতার বিশালত্ব কম বিধায় কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে পত্রিকার শিরোনাম হন। ভুলে যান নিজেদের কর্তৃত্বের পরিধি। এমন সব কাজ করেন, যা প্রচলিত আইনের পরিপন্থীও বটে। তাঁদের কর্তৃত্বের পরিধি এতটা বেশি যে তাঁদের আইনের কাঠামোর মধ্যে আনা দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। কেননা অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণের পুরো জামিনদার তাঁরা নিজেরাই। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ফল ভালো না হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। শিক্ষক একটি মাত্র কারণ। শিক্ষকদের অবহেলাকে দায়ী করা সাজে; কিন্তু পারিপার্শ্বিক বহুবিধ কারণ রয়েছে, যার জন্য শিক্ষার্থীদের ফল ভালো হয় না। আমার কর্তৃত্ব রয়েছে শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করার। আমি তা করলাম। এর মাধ্যমে কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? হয়তো না; কিন্তু আমার কর্তৃত্ব আমি প্রয়োগ করলাম। এর দ্বারা একটি পরিবারের বিশাল ক্ষতি হতে পারে, আমি তা ভাবলাম না। তবে আমি আমার ক্ষমতা ব্যবহার করেও বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে পারি। তবে সে ক্ষেত্রে নিজের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করি না। অন্যে আমাকে ভয় করবে কিংবা সব সময় তটস্থ থাকবে, এর সুযোগ নেই। এখানে পত্রিকায় আমাকে নিয়ে লেখালেখি হবে- তারও সুযোগ নেই। যেন কর্তৃত্বের প্রয়োগেই সুখ বেশি। ক্ষমতা নিজের ভেতরে রাখাই শ্রেয়। অবশ্য সবার ক্ষেত্রে নয়। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল শিক্ষা বিশেষজ্ঞ নজরুল ইসলাম খানের সঙ্গে একটি আলোচনায় অংশগ্রহণের। আমি তাঁর সক্ষমতার পরিধি অনুধাবন করতে পেরেছিলাম। শিক্ষার সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার তিনি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। আমিও আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষক মুগ্ধ হয়েছিলেন তাঁর ক্ষমতা দেখে।
আমার কর্তৃত্ব আছে, কাউকে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে এসে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে সাজা দেওয়ার। যাঁর প্রতি এমন আচরণ করা হয়েছে, তিনিও একজন সরকারি গেজেটেড কর্মকর্তা। তাঁর অপরাধ, তিনি মৎস্য অবমুক্তকরণের টাকা নয়ছয় করেছেন। ধরে নিলাম, অভিযোগ সত্য। কিন্তু এ ধরনের আচরণ না করলে বড় কোনো ক্ষতি হতো কি? তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যেত। তাঁর বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করা যেত। কিন্তু তা না করে সবার সামনে তাঁকে হেয় করা হলো। কাজটি যিনি করলেন, তিনি কর্তৃত্ব প্রয়োগ করলেন মাত্র। যেহেতু তা প্রয়োগ করার অধিকার তাঁর রয়েছে। ঘটনাটি তাঁর বেলায় ঘটলে তিনি কি লজ্জা পেতেন না? কেউ কেউ আক্রোশের বশবর্তী হয়েও কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে থাকেন। যেহেতু কর্তৃত্ব প্রয়োগের ক্ষমতা তাঁর রয়েছে, সেহেতু করতে দোষ কী? এ কাজগুলো হয়রানির শামিল। কর্তৃত্ব এই নয় যে এর প্রয়োগ করতেই হবে। প্রয়োগেই তৃপ্তি- এ ধরনের মনোভাবের পরিবর্তন আমাদের মধ্যে আসা উচিত।
এবার যেন কর্তৃত্বের বালাই নেই, আছে ক্ষমতার দাপট। সবাই এ কাজ করতে পারে না। এ ক্ষমতা ইতিবাচক কোনো গুণ নয়, নয় অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তারের অংশ। এ ক্ষমতা নিজেকে জাহির করা এবং অন্যকে দেখানোর ক্ষমতা। ক্ষমতা প্রয়োগের পর অনুশোচনাও কাজ করেছে। কাউকে শারীরিকভাবে আঘাত করা কোন ধরনের ক্ষমতা? এটি যেমন কর্তৃত্বের মধ্যে পড়ে না, তেমনি ক্ষমতাও নয়। অপরাধ হতে পারে, এর অর্থ এই নয় যে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে শাস্তি দিতে হবে। প্রশ্ন হলো, এ ধরনের কর্তৃত্ব তার রয়েছে কি না? শিক্ষকের অপরাধ তিনি ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক কসরত শেখাতেন না। শোনা মাত্র চড়-থাপ্পড়। আশার কথা হলো, এ ধরনের আচরণের জন্য তিনি ক্ষমা প্রার্থনাও করেছেন।
আমাদের সমাজের দায়িত্বশীল সেবকদের (যাঁরা নিজেদের রাষ্ট্রের সেবক হিসেবে দাবি করেন) কাছ থেকে আমরা প্রায়ই এ ধরনের আচরণ পেয়ে থাকি। এটিকে কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা যা-ই বলুন না কেন, প্রয়োগেই যত সমস্যা। যিনি প্রয়োগ করছেন তাঁর যুক্তি হতে পারে, প্রয়োগ না করলে আইনের শাসন বজায় থাকবে না। আর আমরা মনে করি, যখন-তখন যথেচ্ছ, অহেতুক প্রয়োগ না করলেও ক্ষতি নেই। যখন দেখব এর প্রয়োগ মানুষকে কষ্ট দেয়, হেয়প্রতিপন্ন করে, মর্যাদাহানিকর- তখন তা না করাই কি ভালো নয়। আমার কর্তৃত্ব আছে, আমি তা প্রয়োগ করতে পারি। আমার তাতে কিছু যায়-আসে না; কিন্তু অন্যের জন্য হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হলে তা প্রয়োগ না করাই কি ভালো নয়? যাঁদের নিয়ে লিখলাম, তাঁরা ভেবে দেখবেন কি?
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
neazahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.