গণরায়- দশম সংসদ নির্বাচন ও নিরাপত্তা ভাবনা by আলী ইমাম মজুমদার

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন দ্রুত এগিয়ে আসছে। আগাম নির্বাচন হতে পারে বলেও কিছু সংবাদ এসেছে। তবে সংবাদটি যথার্থ নয় বলে মন্তব্য করেছে দায়িত্বশীল মহল। এটা এ আলোচনার মূল বিবেচ্য বিষয় নয়।


আগাম না হলেও সংবিধানের নির্দেশনা অনুসারে ২০১৩ সালের শেষ দিকে কিংবা এর পরের বছরের সূচনায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। সে নির্বাচনের সময় সামরিক বাহিনী নিয়োগের আপাতত কোনো পরিকল্পনা নেই, বেসামরিক নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে ভোট গ্রহণ নির্বিঘ্ন করতে বিভাগওয়ারি ভিন্ন ভিন্ন তারিখে ভোট গ্রহণের একটি পরিকল্পনার কথাও খবরের কাগজে এসেছে। এ খবরটির প্রথমাংশ সম্পর্কে নির্বাচন কমিশন থেকে পর পর দুই দিন ভিন্ন রকম বক্তব্য দেখা গেল। ৯ অক্টোবর ২০১২ সিইসি কূটনীতিকদের সঙ্গে এক বৈঠকে আগামী সংসদ নির্বাচনে সেনা নিয়োগের পরিকল্পনা নেই বলে তাঁদের জানিয়েছেন মর্মে কমিশনের সচিব গণমাধ্যমকে বলেছিলেন। পরদিন গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সিইসি বলেন, সংবাদটি ভুলভাবে এসেছে। এ ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আর শেষাংশের সমর্থন বা অসমর্থনে কোনো বক্তব্য এখনো দেখা যায়নি। তবে এ ব্যাপারে ব্যাপক মতৈক্য আছে যে বেসামরিক প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য যেখানে থাকে, সে কাজের জন্য সামরিক বাহিনী নিয়োগ যথাযথ নয়।
এখন নির্বাচন ভাবনাটা এবং এর নিরাপত্তাব্যবস্থার ওপর আলোকপাত করতে চাই। দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল বা জোট সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর আলোকেই নির্বাচন করতে অনেকটা অনমনীয় অবস্থানে রয়েছে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের সময় সরকারের আকৃতি কিছুটা ছোট করে এর অধীনেই দেশের অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাহী কার্যক্রম চলবে বলে তারা বলছে। কয়েক দিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এক ঘোষণায় বলেছেন, নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে। আর গত ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত কৃষিমন্ত্রীর এক সাক্ষাৎকারে অনেক কথার মধ্যে তিনি এটাও বললেন যে সে সময়ে সংসদ অধিবেশনে না বসলেও বহাল থাকবে। তিনি প্রবীণ, দায়িত্বশীল রাজনীতিক এবং নিজের মন্ত্রণালয় পরিচালনায় দৃশ্যমান সাফল্যের ছাপ রেখেছেন। তবু আমরা ধরে নেব, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যই চূড়ান্ত। তিনি নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ থাকতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন। এতে অচলাবস্থা কেটে যাওয়া সম্পর্কে ক্ষীণ আশাবাদ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল ও তাদের সহযোগী দলগুলো যে নামেই হোক, একটি নির্দলীয় সরকারের অধীন ব্যতিরেকে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে। অচলাবস্থা দূরীকরণে উভয় পক্ষের কোনো সংলাপের উদ্যোগও দেখা যায় না, বরং দেখা যায়, একজন প্রবীণ খ্যাতিমান আইনজীবীর একটি উদ্যোগ সূচনাতেই হোঁচট খেয়েছে। এক-এগারোর পর আমাদের দুই প্রধান নেত্রীর সমর্থক শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীদের বেশ কয়েকজন নীরব অবস্থান নিলে তিনি সুপ্রিম কোর্টে তাঁদের উভয়ের হয়ে মামলায় লড়েছেন। তাঁর কথা সম্পূর্ণ সঠিক বা মানতেই হবে, এমন নয়। তবে তাঁকে উপেক্ষা করাও একটি বড় ভুল। তা সত্ত্বেও বিনা দ্বিধায় বলা যায়, প্রধান প্রধান সব দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক, এটা সবাই চায়। এর ভিন্ন কিছু গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করবে আর অস্থিতিশীল হবে দেশ—এ আশঙ্কাকে অমূলক বলা যাবে না। বলা প্রয়োজন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে এর নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পর্কে তেমন কোনো আলোচনার আবশ্যকতা নেই।
আমরা আশাবাদী হতে চাই। বিশ্বাস করতে চাই, আগামী নির্বাচন হবে সব দলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে। তাই এর নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পর্কে ইতিপূর্বের নির্বাচনগুলোর (১৯৯১, ১৯৯৬ সালের জুন, ২০০১ ও ২০০৮) অভিজ্ঞতার আলোকে আগামী নির্বাচনের নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পর্কে ভাবতে হবে। উল্লিখিত নির্বাচনগুলোর একটিতে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ এ নিবন্ধকারের হয়েছিল। দেখা গেছে, মফস্বল কেন্দ্রগুলোতে একজন সশস্ত্র পুলিশ, একজন সশস্ত্র আনসার এবং নয়জন লাঠিধারী আনসার নিয়োগ করা হয় কেন্দ্রের নিরাপত্তার জন্য। ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে সশস্ত্র পুলিশ/আনসার চার-পাঁচজন। বেশ কিছু কেন্দ্রকে আওতায় নিয়ে প্রতি উপজেলায় গড়ে তিন থেকে পাঁচটি পুলিশ, বিজিবির (সাবেক বিডিআর) ভ্রাম্যমাণ দল থাকে। তেমনি উপজেলা সদরে তাদেরই দু-একটি স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকে। নবম সংসদ নির্বাচন থেকে র‌্যাবও যুক্ত হয়ে এ ধরনের ভ্রাম্যমাণ দল ও স্ট্রাইকিং ফোর্সের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। আর উপজেলাভিত্তিক থাকে সামরিক বাহিনীর (মূলত সেনাবাহিনী এবং উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে নৌবাহিনী) কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ দল। সারা দেশে এক দিনে সংসদ নির্বাচন হওয়ায় এ ধরনের একটি নিরাপত্তাব্যবস্থাকে সরকারের সামর্থ্যের মধ্যে পর্যাপ্ত বলে বিবেচনা করা হয়। তদুপরি এ চারটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল নির্দলীয় সরকারের আওতায়। তাই সরকার/নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ নির্বাচনের দৃঢ় প্রত্যয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে মাঠপর্যায়ের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নির্বাচনগুলো সফল হয়।
অন্যদিকে দেখা যায়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো এবং জাতীয় সংসদের কোনো উপনির্বাচন ভিন্ন ভিন্ন তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। তাই সেখানে বেসামরিক নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপক সমাবেশ ঘটানো সম্ভব হয়। বিরল দু-একটি ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী (চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বিগত নির্বাচন উল্লেখ্য) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের বিগত নির্বাচনে বেসামরিক নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সম্মিলিত সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ হাজার। তার পরও সেখানে সামরিক বাহিনী নিয়োগের দাবি এসেছিল। এটা অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় এ ধরনের ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী নিয়োগের দাবির বিরুদ্ধে এ পত্রিকায়ই এ নিবন্ধকারের একটি কলাম এসেছিল। এতে যুক্তি ছিল, এত ব্যাপকসংখ্যক নিরাপত্তা বাহিনীর সমাবেশ, গণমাধ্যমের তীক্ষ নজরদারি আর পর্যবেক্ষকদের সতর্কতায় এখানে সামরিক বাহিনী ব্যতিরেকেই সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে।
আর দেশব্যাপী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বেসামরিক নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি, গণমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকদের নজরদারি উল্লিখিত নির্বাচনটির সঙ্গে তুলনা করলে নগণ্যই বলতে হবে। সেখানে সামরিক বাহিনী ছাড়া নির্বাচন করার চিন্তাও বিপর্যয়কর বলে মনে হয়। আরও একটি বিষয় বিবেচনায় রাখা দরকার, সেটি হলো সরকারপরম্পরা মাঠ প্রশাসন ও পুলিশের বিবেচনাহীন দলীয়করণের ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো চাপের মুখে নিরপেক্ষ আচরণ করতে সক্ষম হবে কি না, এ সম্পর্কে জনসাধারণের একটি বড় অংশ সংশয়বাদী। তাই ছোটখাটো নির্বাচনেও সেনা নিয়োগের দাবি আসে প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটির ওপর অধিক আস্থা আছে বলেই। এটা স্বীকার করতেই হবে যে সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ, অন্তত মধ্য পর্যায় পর্যন্ত পদোন্নতি ও পদায়ন সম্পূর্ণ দলীয় প্রভাবমুক্ত। যোগ্যতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও পেশাদারির নিরিখে তা সম্পন্ন করা হয়। আর পুলিশসহ বেসামরিক প্রশাসনের সব স্তরে চলছে এর বিপরীতমুখী কার্যক্রম। ফলে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর ধার-ভার সব নষ্ট হতে চলেছে। তাই জনগণের এ দাবিকে অমূলক বলা যাবে না। তবে যাঁরা গণতান্ত্রিক শাসন চান, তাঁদের জন্য এটা শুভসংবাদ হতে পারে না।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি এক দিনে না হয়ে বিভিন্ন দিনে ভিন্ন ভিন্ন জেলায় হয়, তবে ভোট গ্রহণের সময় বেসামরিক নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর উপস্থিতি বর্তমানে প্রচলিত এক দিনে ভোট গ্রহণের ব্যবস্থার চেয়ে কিছুটা বৃদ্ধি পাবে। এ ধরনের নির্বাচন করার জন্য সুশীল সমাজের একটি মহল বিভিন্ন সময়ে দাবি করেছে। তবে একটি বিষয় স্মরণে রাখতে হবে, ভারতের মতো ভিন্ন ভিন্ন তারিখে নির্বাচন করা হলেও ভোট গণনা ও ফল প্রকাশ করতে হবে সর্বত্র ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর। সিল মারা সেই ব্যালট পেপারসংবলিত ভোটের বাক্সগুলো রাখতে হবে নিরাপত্তা বাহিনী পরিবেষ্টিত একটি সুরক্ষিত স্থানে। গণনা করতে হবে বিশাল কোনো মিলনায়তনে, সব প্রার্থীর এজেন্টের সামনে। ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা হলে গণনা অনেক সহজ হতো। আমাদের প্রধান বিরোধী দল দুর্বোধ্য যুক্তিতে এটার বিরুদ্ধে অবস্থান নিল। ইভিএমে ভোট গ্রহণের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যথাক্রমে অন্তত প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ও পুরো দেশ এর আওতায় চলে আসত। নির্বাচন কমিশন হয়তো বা বিরোধী দলের মধ্যে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে আগামী নির্বাচন ইভিএমে হবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যা-ই হোক, আমাদের পেছনে চলার তালিকায় আরেকটি অধ্যায় যুক্ত হলো। এখন প্রশ্ন, এসব ব্যালট বাক্স রাখার সুরক্ষিত স্থাপনা জেলা বা উপজেলায় হয়তো পাওয়া যাবে, তবে প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর একটি আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি না করে এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া কি সুফল দেবে? বরং চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে এর বিশ্বাসযোগ্যতা। তদুপরি এ ধরনের নির্বাচনেও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রয়োজনেই আরও কিছুকাল সামরিক বাহিনী নিয়োগের আবশ্যকতা থেকে যাবে।
তা হলে দেখা যায়, ব্যাপক রাজনৈতিক মতৈক্য ছাড়া ভিন্ন ভিন্ন তারিখে সংসদ নির্বাচনের ধারণা গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে সে ধরনের মতৈক্য সৃষ্টি করে এ ব্যবস্থায় যেতে পারলে ভালোই হতো। এর খুঁটিনাটি নিয়ে খোলামেলা বিশদ আলোচনার আবশ্যকতা রয়েছে। অন্যথায় বর্তমানে প্রচলিত ব্যবস্থাতেই আমাদের থাকতে হবে। আর সে নির্বাচনকালে সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি অপরিহার্য বলে তো মনে করাই স্বাভাবিক।
 আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

No comments

Powered by Blogger.