কেন আমি মো ইয়ান by মো ইয়ান

লেখক হওয়ার পেছনে প্রত্যেক লেখকের নিজস্ব কারণ থাকে, আমিও এর ব্যতিক্রম নই। কিন্তু কেন আরেকজন হেমিংওয়ে বা ফকনার না হয়ে আমি আমার মতো লেখক হলাম? আমার ধারণা, শৈশবের অভিজ্ঞতার সঙ্গে এর যোগ আছে।


শৈশবের অভিজ্ঞতা আমার লেখক জীবনে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে, লক্ষ্যে স্থির থেকে এগিয়ে যেতে প্রেরণা জুগিয়েছে। ৪০ বছর আগে ষাটের দশকের শুরুর চীনকে ফিরে দেখলে উদ্ভট একটা সময়কে খুঁজে পাই, সেটা ছিল অভূতপূর্ব উগ্র একটা কাল। একদিকে এই বছরগুলো দেশকে অর্থনৈতিক স্থবিরতার মুষ্টিবদ্ধ অবস্থায় প্রত্যক্ষ করেছে, সঙ্গে ছিল ব্যক্তিক বঞ্চনাও। মানুষ মৃত্যুকে দুয়ার থেকে দূরে রাখতে লড়াই করেছে, খাবার ছিল সামান্য, বস্ত্রের জন্য বরাদ্দ ছিল ত্যানা। অন্যদিকে এটা ছিল নিবিড় রাজনৈতিক প্রত্যয়ের স্বপ্নে বিভোর এক সময়। অভুক্ত মানুষ এ সময় শক্ত করে বেল্ট বেঁধে কমিউনিস্ট নিরীক্ষায় পার্টিকে সমর্থন জানিয়েছিল। তখন ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর থাকলেও আমরা নিজেদের ভেবেছি পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান মানুষ হিসেবে। বিশ্বের অধিবাসীদের দুই-তৃতীয়াংশ আমরা। ভীষণ কৃচ্ছ্রতার মধ্যে থেকেও তখন বিশ্বাস করেছি, এটি আমাদের পবিত্র দায়িত্ব, যারা ভোগান্তির সমুদ্রের মধ্যে ডুবছে তাদের রক্ষা করার উপায়। আশির দশকে চীন বিশ্বের দিকে দরজা খোলা পর্যন্ত চলল, অবশেষে আমরা বাস্তবতাকে মোকাবেলা করতে শুরু করলাম। যেন স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে এলাম। শিগগিরই আমি শিখে গেলাম কীভাবে নিজের সঙ্গে কথা বলা যায়। আমি রপ্ত করলাম আত্মপ্রকাশের অসাধারণ রীতি_ মুহুর্মুহু বলতে পারে শুধু বাগ্মিতা সহকারে নয় এমনকি কবিতাতেও যা প্রকাশিত হতে পারে। একবার মা শুনে ফেলল, আমি গাছের সঙ্গে কথা বলছি। গভীর চিন্তায় পড়ে তিনি বাবাকে বললেন, পুত্রের পিতা, তোমার কি মনে হয় না ওর কোনো সমস্যা হয়েছে? পরে যথেষ্ট বড় হওয়ার পর আমি বড়দের সমাজে ঢুকলাম শ্রমিক ব্রিগেডের একজন সদস্য হিসেবে। তখনও পুরনো অভ্যাসবশত গরু চরানোর সময় আমি নিজে নিজে কথা বলতাম। এটা আর কোনো সমস্যা তৈরি না করলেও আমার পরিবারে বড় আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। আমার মা অনুরোধ করে বললেন, পুত্র, তুমি কি কখনও কথা বন্ধ করতে পার না? তার মুখভঙ্গিতে আমার চোখে পানি এসে গেল, আমি কথা দিলাম, কথা বন্ধ করব। কিন্তু ওই মুহূর্ত থেকে সব কথাই আমি জমা করেছি ভেতরে, ইঁদুরেরা যেভাবে বাসা ভরিয়ে তোলে নানা কিছুতে। সেটার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তীব্র অনুশোচনা ও উপচেপড়া অনুভব যে আমি আমার মায়ের অনুজ্ঞাকে অন্তরে জায়গা দিতে পারিনি। এ কারণেই আমি মো ইয়ান বা কথা বলো না শব্দগুলোকে আমার ছদ্মনাম হিসেবে বেছে নিয়েছি। তখন আমার ধৈর্যহারা মা প্রায়ই বলতেন, কুকুরকে পশুবিষ্ঠা থেকে দূরে রাখা যায় না, নেকড়েকেও মাংস খাওয়া থেকে বিরত রাখা সম্ভব না। আমি কথা বলা বন্ধ করতে পারিনি। এই মুখরতার কারণে আমার অনেক সহলেখক আহত হয়েছেন। কেননা আমার মুখ থেকে স্বভাবতই যা বেরিয়ে আসে তা হলো আছোলা সত্য। এখন আমি মধ্য বয়সে, শব্দগুলো ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। মনে হয়, মার অনুজ্ঞা মেনেই তারা এমন আচরণ করছে আর আমার দিকে চেয়ে দেখছে।

নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ২০১২ বিজয়ী মো ইয়ানের 'শিফু, হাসির জন্য তুমি সবকিছু করবে' বই থেকে।
ভাষান্তর : মাহবুব মোর্শেদ

No comments

Powered by Blogger.