বিএনপির তদন্ত কমিটির রিপোর্ট-রামুর ঘটনার ব্যাপারে গঠিত বিএনপির তদন্ত কমিটির রিপোর্টের সারসংক্ষেপ

১. ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১২ রাত ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার দিকে ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে শ'খানেক লোক নিয়ে মিছিল শুরু হয়। এরপর যে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয় তাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দা, সেখানকার ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন এবং আগুনে পোড়া বিহারের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সাক্ষ্য প্রদান করেন।


সরকারের নিষ্ক্রিয়তাই এ ঘটনাপ্রবাহ সংঘটিত হতে সব ধরনের সহায়তা করেছে। ২. পরবর্তী ২ ঘণ্টার মধ্যে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় তা ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পেয়ে সহস্রাধিক জনমিছিলে পরিণত হয় তা একমাত্র সরকারের পরোক্ষ সমর্থন ছাড়া সম্ভব হয়নি। সরকারের এটি পূর্বপরিকল্পিত না হলে প্রশাসন অতি স্বল্প সময় এবং অতি দ্রুততার সঙ্গে জনতার এ উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ ও তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে সমর্থ হতো। ৩. দীর্ঘ সময়ের এ ভয়াবহতা পুলিশ বাহিনী বা সরকারের কোনো আইন সংস্থা থেকে কোনো রকম প্রচেষ্টা নেওয়া হয়নি_ যে কারণে রামু, উখিয়া, টেকনাফ ও পটিয়ার ঘটনা আজ জাতীয় ট্র্যাজেডিতে পরিণত হয়েছে। ৪. থানাকে অবহিত করার পরও তারা কোনো দায়িত্ব নেয়নি। থানার সদর পুলিশ স্টেশন ছিল ঘটনাস্থলের অতি কাছে। মাত্র এক কিলোমিটারের মধ্যে। এই উদ্ভূত পরিস্থিতি শান্ত বা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তারা কোনো ভূমিকাই পালন করেনি। ৫. জেলা পুলিশ সদর ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে। পুলিশ সুপারকেও বারবার অবহিত করার পর দীর্ঘ দুই-তিন ঘণ্টা সময়ের মধ্যে কোনো রকম ব্যবস্থা গ্রহণ না করাতে এ ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়; যা সরকারের নীরবতারই বহিঃপ্রকাশ। এ থেকে বোঝা যায়, পরোক্ষভাবে সরকারেরই ইন্ধনে ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়েছিল। ৬. ঘটনাস্থল থেকে আর্মি ক্যাম্পের দূরত্ব ছিল মাত্র ৪ কিলোমিটারের মতো। তারাও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের উপাসনাস্থল বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসেনি। সেখানকার প্রত্যক্ষ সাক্ষীরা বলছেন, তারা যথাসময়ে এগিয়ে এলে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না। আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, সরকার এ দায়িত্ব কোনোভাবে এড়াতে পারে না। ৭. ঘটনার সূত্রপাত ২৯ সেপ্টেম্বর রাত ৯টা থেকে সাড়ে ৯টায় হলেও পরবর্তী অগি্নসংযোগ, ভাংচুর, লুটপাট ও আক্রমণ পরদিন ভোররাত প্রায় ৫টা পর্যন্ত চলে এবং পরদিন অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বর এ নগ্ন কার্যক্রম চলতে থাকে পার্শ্ববর্তী উপজেলা উখিয়া ও টেকনাফের কতিপয় বৌদ্ধবিহার ও বসতবাড়িতে। শুধু তাই নয়, এর ভয়াবহতা সহজেই আঘাত হানে পটিয়ায়। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, সরকারের দায়িত্বশীল এজেন্সিগুলো, বিশেষ করে পুলিশ, র‌্যাব ও সেনাবাহিনী ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোনো রকম পদক্ষেপ গ্রহণ না করে সম্পূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করে; যা সরকারেরই দায়িত্বহীনতার পরিচয়। ৮. উত্তম কুমার বড়ূয়া, যাকে কেন্দ্র করে এ পরিস্থিতির উদ্ভব তাকে সরকার এখনও জনসমক্ষে হাজির করতে পারেনি। এটি সরকারের চরম ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। ৯. ঘটনার পর রামু সদরের এত বাড়িঘর, বিহার-প্যাগোডা ভস্মীভূত হলো কিন্তু বাজারের পূর্ব দিকে ওইসব বিহারের পার্শ্ববর্তী উত্তম কুমার বড়ূয়ার বাড়ি অক্ষত রইল, বরং তার বাড়িই বেশি আক্রান্ত হওয়ার কথা ছিল। ১০. উপরোক্ত তথ্যের ভিত্তিতে রামু, উখিয়া, টেকনাফ ও পটিয়ার এসব জঘন্য ঘটনায় সরকার আশু ব্যবস্থা নিতে এবং নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, যা পত্রপত্রিকার রিপোর্টসহ পরিদর্শনকারী সব মানুষের কাছে স্পষ্ট। এতে ওইসব জনপদে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতি দারুণভাবে বিনষ্ট হয়েছে, যা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে।
সুপারিশমালা : আক্রান্ত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ এবং ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণ নাম প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছে। কারণ তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং আরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভয়ের কারণ রয়েছে। তারা প্রশ্নোত্তর ও জিজ্ঞাসায় বলছে, ঘটনার পর থেকে বারবার স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে যাদের নাম এসেছে এগুলো সঠিক। এদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। অতএব, উপরোক্ত তথ্য ও সরেজমিন তদন্তের ভিত্তিতে তদন্ত টিম কর্তৃক ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে কক্সবাজারের রামু, উখিয়া, টেকনাফ ও চট্টগ্রামের পটিয়ার তদন্ত বিবরণীর সুপারিশগুলো নিম্নে প্রদান করা হলো :
প্রথমত, স্থানীয় সাক্ষীদের জবানবন্দি ও ঘটনাস্থল পরিদর্শনে তথ্যাদিতে প্রমাণিত হয়, ঘটে যাওয়া এসব নারকীয় ঘটনা তথা বিহার, মন্দির, প্যাগোডা ও বসতবাড়ি ভস্মীভূত করা, ভাংচুর করা, লুটতরাজসহ দুষ্কৃতকারীদের মদদ দেওয়ার জন্য সরকারই দায়ী; যেহেতু তাদের সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, যারা এ রকম জঘন্য কর্ম ঘটিয়েছে সেই প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির বিধান করতে হবে এবং এতদসঙ্গে সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যারা যথাসময়ে দায়িত্ব পালন করেনি তাদেরও যথাযথ শাস্তি দিতে হবে। তৃতীয়ত, এ ঘটনাকে পুঁজি করে সরকার বিরোধী দলের ওপর যে মিথ্যা অভিযোগ ও হয়রানি করছে তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং সরকারি তদন্তের আগেই বিরোধী দলের সংসদ সদস্যকে দোষী সাব্যস্ত করে দেওয়া বক্তব্য সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিধায় অবিলম্বে তা প্রত্যাহার করতে হবে। চতুর্থত, ওইসব জনপদে বসবাসরকারী সব জনগোষ্ঠী তথা সংখ্যালঘুদের দ্রুত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে এবং তাদের আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পঞ্চমত, তাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত বিহার, প্যাগোডা, মন্দির ও বসতবাড়ি নির্মাণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে এবং ওইসব মূল্যবান স্থাপনা ও ঐতিহ্য যেন পুনরায় নতুনভাবে তৈরি করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় সেই দায়িত্বও সরকারকে অবিলম্বে নিতে হবে। সর্বশেষ : অতিদ্রুত একজন সাবেক প্রধান জ্যেষ্ঠ বিচারপতির নেতৃত্বে একটি বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে এর রহস্য উদ্ঘাটন করতে হবে। এ ছাড়া এ দেশের ধর্ম-বর্ণ সব সম্প্রদায়ের শান্তি-শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতির বন্ধন যেন বিনষ্ট না হয় এবং দেশের সার্বভৌমত্বেও যেন আঘাত না আসে এবং আগামীতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে জন্য সরকারকে পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে।
 

No comments

Powered by Blogger.