গতকাল সমকাল-প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর—একটি মূল্যায়ন by ফারুক চৌধুরী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৭ থেকে ২১ মার্চ পর্যন্ত চীনে পাঁচ দিনের একটি সরকারি সফর করলেন। সফরে তাঁর প্রতিনিধি দলে অন্যদের মধ্যে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি। এই নিবন্ধটিতে চীনের সঙ্গে কীসব চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো, কী সমঝোতাপত্র চূড়ান্ত হলো অথবা চীন থেকে আমরা কী পেলাম বা কী পেলাম না, সে বর্ণনা অথবা হিসাবে যাব না।


এ নিয়ে দেশবিদেশের সংবাদমাধ্যমে বিস্তারিত সব এসেছে—তাই তার পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। তবে বলা উচিত হবে যে অন্যসব সহযোগিতার মধ্যে আমাদের বিবিধ অবকাঠামো ও যাতায়াতব্যবস্থা উন্নয়নে, চীনের অতীত সহায়তা এবং আগামীর প্রতিশ্রুতি আমাদের দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান মৈত্রীকে উন্নততর করেছে। প্রতিরক্ষাক্ষেত্রে চীন থেকে আহরিত অস্ত্রসম্ভার করেছে আমাদের প্রতিরক্ষা শক্তিকে দৃঢ়তর। চীনের সঙ্গে আমাদের বার্ষিক বাণিজ্যিক লেনদেন এখন বছরে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারেরও বেশি—তবে চীনের অনুকূলে একপেশে এই বাণিজ্য আমাদের রপ্তানি অঙ্গনের জন্য বৃহত্ একটি চ্যালেঞ্জ যে বাণিজ্য ঘাটতি কেবল বর্তমানে প্রধানত পাট আর চামড়াজাত দ্রব্য রপ্তানিতে মেটানোর নয়। তবুও সব মিলে গত সাড়ে তিন দশকে চীন আর বাংলাদেশের সম্পর্কের পরিধি বিস্তৃততর হয়েছে।
এ বছরই চীন আর বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৩৫ বছর পূর্ণ হতে চলল। চীনে দশক অথবা অর্ধদশককে চিহ্নিত করার রেওয়াজ আমাদের চেয়ে বেশি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এ বছরের প্রারম্ভে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৩৫ বছরের মাথায় প্রধানমন্ত্রীর সফল চীন সফরের একটি বিশেষ দ্বিপক্ষীয় তাৎপর্য আছে বৈকি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হালেই ভুটান এবং ভারত সফর করেছেন। ভুটানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নিবিড়তর হয়েছে এবং বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের পালে হাওয়া যে লেগেছে তা তো দৃশ্যমানই। আমরা নিকটতম প্রতিবেশী এবং সেই কারণেই বিবিধ সমস্যার উদ্ভব যে সময়ে সময়ে হবে না, তা তো বলা যায় না; তবে সব সমস্যাকেই সম্ভাবনায় রূপান্তরিত করার যে মেজাজটি এখন সঞ্চার সৃষ্টি হয়েছে, তা আশাবাদ সঞ্চার করে বৈকি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের জ্যামিতিক বর্ণনায় এটা বলাই যায় যে গত কয়েক মাসে ভুটানকে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রাথমিক যুগল লক্ষ্য, নিরাপত্তা আর উন্নয়নের স্বার্থে তার বিদেশ নীতির কয়েক মাসের কাঁটা ঘুরিয়ে ভারত, চীন আর মিয়ানমারকে নিয়ে একটি বলয় রচনার প্রশংসনীয় প্রয়াস নিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর শেষে একটি যুগ্ম বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে ‘দুই পক্ষ সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারের (বিসিআইএম) আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ এবং উন্নীতকরণের প্রচেষ্টায় একমত হয়েছে।’ এই প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশ-চীন ব্যবসা ফোরামের একটি ভোজসভায় শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের সহযোগিতা কামনা করলেন। তিনি বললেন, চীন এবং অন্যান্য ‘সব প্রতিবেশী রাষ্ট্র’ বন্দরটি ব্যবহার করতে পারবে। এটা ভারতের প্রতি সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিতবাহী। আবার আঞ্চলিক সহযোগিতার একই ভাবনায় তিনি কুনমিং এ মিয়ানমার হয়ে চীন আর বাংলাদেশের মধ্যে সড়ক আর রেল যোগাযোগের কথা বললেন, যাতে ইউনান প্রদেশের নেতারাও শেখ হাসিনার ভাষায় ‘উল্লেখযোগ্য ভূমিকা’ পালন করতে পারেন। এই গভীর সমুদ্রবন্দরটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর জন্য উন্মুক্ত করলে প্রকল্পটিতে তাদের আগ্রহ বাড়বে এবং বাংলাদেশও আর্থিকভাবে লাভবান হবে।
ব্রহ্মপুত্র নদী চীন থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়। অতএব নদীটির বেলায় ভারত আর বাংলাদেশ দুই-ই ভাটির দেশ। যদি কোনো কারণে চীন, ব্রহ্মপুত্র, নদীর পানি ভিন্নমুখে প্রবাহিত করতে উদ্যোগী হয় তাহলে তা ভারত আর বাংলাদেশ, দুয়ের জন্য মঙ্গলকর হবে না। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর শেষের যুগ্ম বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে দুই পক্ষই ইয়ারলুজানবু, ব্রহ্মপুত্র নদীর পানিসম্পদ ব্যবহার সম্বন্ধে তথ্যবিনিময় এবং আলাপ- আলোচনার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে কথা বলেছে। যাতে করে ‘টেকসই এবং পারস্পরিক লাভজনক সহযোগিতা নিশ্চিত করা যায়’। দুই পক্ষ এতেও একমত যে ‘নদীতীরে অবস্থিত প্রতিটি দেশকে’ অন্তর্ভুক্ত করে এই আলাপ-আলোচনার জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টিও পরীক্ষা করা যেতে পারে। এই প্রকল্পটিতে আঞ্চলিক আগ্রহ এতে অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে।
ষাটের দশকে যখন চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক নিবিড় হওয়ার পথে, তখন পিকিংয়ে (বর্তমান বেইজিং) পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত ছিলাম। তখন প্রত্যক্ষ করেছি যে চীনের সেই সময়ের নেতারা, বিশেষ করে মাও সে তুং এবং চৌ এন লাই বিশ্বাস করতেন যে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি সুবিচার ব্যতিরেকে যথার্থ অর্থে পাকিস্তানের উন্নয়ন সম্ভব নয়। চট্টগ্রামে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে শেখ হাসিনা চীনের সাহায্য কামনা করেছেন। এ বিষয়ে অতীতের একটি ঘটনা ব্যক্ত করা প্রাসঙ্গিক হবে। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের তদানীন্তন বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াহিদুজ্জামানের চীন সফরের সময়ে মন্ত্রী মহোদয়কে চেয়ারম্যান মাও প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের দৈনিক মালামাল ওঠানো-নামানোর ক্ষমতা (handling capacity) কত? সেদিন সেই প্রশ্নটির তাত্ক্ষণিক উত্তর মন্ত্রী অথবা তাঁর প্রতিনিধিদলের আমরা কেউই দিতে পারিনি। তখন চেয়ারম্যান মাও বলেছিলেন ‘চট্টগ্রাম বন্দরকে উন্নততর করুন। পূর্ব পাকিস্তানের আধুনিক বন্দরের প্রয়োজন রয়েছে।’ এই ঘটনাটি আমি এর আগে চীন সম্বন্ধে আমার লেখনীতে একাধিকবার ব্যক্ত করেছি। এখন যখন তাঁর সাড়ে চার দশক পর চট্টগ্রামে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে শেখ হাসিনা চীনের সহযোগিতা কামনা করলেন, তখন প্রাসঙ্গিকভাবেই সেই ঘটনাটি মনে পড়ছে।
চীন এবং ভারত—বাংলাদেশের বৃহদাকার শক্তিশালী প্রতিবেশী দুই দেশ। অতএব, এটা স্বাভাবিক যে এই দুই দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থাপনে ভারসাম্যতা আনতে বাংলাদেশ আগ্রহী হবে। তবে শেখ হাসিনার সদ্যসমাপ্ত চীন সফরে একটি নতুন উদ্যোগ স্পষ্টভাবেই প্রতিভাত হয়। তা হলো বাংলাদেশ চাইছে যে বাংলাদেশ, চীন, ভারত আর মিয়ানমারের মধ্যে আঞ্চলিক যোগাযোগ আর সহযোগিতা বৃদ্ধি পাক, যাতে করে তা এই অঞ্চলের পারস্পরিক সম্পর্ককে নিবিড়তর ও উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। সফরটি আঞ্চলিক সহযোগিতার সম্ভাবনা এবং তার বাস্তবায়নে বাংলাদেশের গভীর আগ্রহ ও অগ্রণী ভূমিকাটি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে।
উল্লেখ্য, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রথম মেয়াদেও একটি সক্রিয় এবং উদ্যোগী বিদেশনীতি অনুসরণ করেছিলেন। এই অঞ্চলের বৃহত্তম অপারমাণবিক রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, পারমাণবিক পরীক্ষার পর সৃষ্ট ভারত-পাকিস্তান অস্থিরতার মধ্যে উত্তেজনা প্রশমিত করতে তিনি দিল্লি আর ইসলামাবাদ ছুটে গিয়েছিলেন। উপমহাদেশ বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিবিড় করতে তিনি ভারত আর পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীদের নিয়ে ঢাকায় একটি বৃহদাকার বাণিজ্যিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত করেছিলেন। এই যাত্রায় তাঁর সরকার, আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিবিড়তর করার উদ্দেশ্যে অবকাঠামোগত অগ্রগতিতে প্রয়াসী। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থান যে একটি সক্রিয় এবং উদ্যোগী (Pro-active) বিদেশনীতি অনুসরণের অনুকূলে তা শেখ হাসিনার ভারত আর চীন সফরে পরিষ্কারভাবেই ফুটে উঠেছে।
শেখ হাসিনার চীন সফর পর্যালোচনায় বলতেই হয় যে দেশটি সম্বন্ধে তাঁর আগ্রহ গভীর এবং চীনের বর্তমান প্রজন্মের নেতাদের সঙ্গে তিনি সুসম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। ২০০৩ সালের নভেম্বরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদের বিরোধী নেতা হিসেবে চীন সফর করেন। সেই সময়ে চীন জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি উ বাংগুও এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর রাজনৈতিক কমিটির সভাপতি জিয়া চিং লিংয়ের সঙ্গে তাঁর বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা হয়। সেই সফরের ছয় বছরেরও কিছু বেশি সময় পর বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা এবার চীন সফর করলেন এবং এই যাত্রায় রাষ্ট্রপতি হু জিনতাও এবং প্রধানমন্ত্রী উয়েনজিয়া বাও তাঁকে স্বাগত জানালেন। ২০০৩ সালে বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনার প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে চীন থেকে ফিরে এসে যেসব ভাবনা ব্যক্ত করেছিলাম তা এখনো পুরো মাত্রায়ই প্রাসঙ্গিক। এটা স্পষ্ট যে চীনের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সাফল্যে চীনের নেতারা শুধু আত্মবিশ্বাসীই নন, দেশের দ্রুত উন্নয়নে তাঁরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং আদর্শগতভাবে একজোট। সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে তাঁদের আটটি করণীয় এবং আটটি বর্জনীয় নীতির পুনরাবৃত্তি করতে চাই। বিশেষ করে এই কারণে যে বাংলাদেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের যেকোনো নির্বাচিত সরকার তা অনুসরণে সুফলভোগী হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। সেই আটটি নীতি হলো:
১। মুক্তমনা হোন, বাস্তবতা থেকে সত্যের সন্ধান করুন। পুরোনো পদ্ধতিকে আঁকড়ে ধরে প্রগতির সম্ভাবনাকে ব্যাহত করবেন না।
২। তত্ত্বের সঙ্গে অনুশীলনকে মেলাতে হবে। যান্ত্রিকভাবে অনুকরণ করবেন না।
৩। জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ রক্ষা করুন। আমলাতন্ত্র ও আনুষ্ঠানিকতা থেকে দূরে থাকুন।
৪। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতির প্রতি অবিচল ও বিশ্বস্ত থাকুন। অযৌক্তিক, আবেগনির্ভর এবং দুর্বল ও শিথিল আচরণ করবেন না।
৫। দলীয় শৃঙ্খলার প্রতি বিশ্বস্ত থাকুন, শিথিল নৈতিকতাবাদের পশ্চাদ্বাবন করবেন না।
৬। সত্ এবং ঋজু হোন, ব্যক্তিগত স্বার্থে ক্ষমতাকে ব্যবহার করবেন না।
৭। সুকঠিন পরিশ্রম করুন, সুখের মধ্যে পরমার্থ সন্ধান করবেন না।
৮। মেধার ভিত্তিতে লোক নিয়োগ করুন এ ক্ষেত্রে অসদাচরণের আশ্রয় নেবেন না।
চীন একটি বিস্ময়কর দেশ। মাত্র ছয় দশকের মধ্যে একটি দুর্বল, দরিদ্র, যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্র থেকে দেশটি একটি অর্থনৈতিক বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছে। চীনের এই অভূতপূর্ব অগ্রযাত্রা ও বিবর্তন, যার রক্ষণ করা আমার কূটনীতিক এবং কলামিস্ট জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়ে রবে।
চীন থেকে আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে। আমাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ক্ষমতা (absorption capacity) এখনো যথার্থভাবে পরীক্ষিত হয়নি বলে আমার বিশ্বাস। তবে উপরিউক্ত আটটি নীতি যদি আংশিকভাবেও আমরা আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আত্তীকরণ করতে পারি তাহলে তা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে মঙ্গলকর হবে।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্র সচিব। কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.