অবৈধ ব্যাংকিংয়ের শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ড-সংলাপ সফলে দুই দলকেই ছাড় দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী

সাত বছরের জেল ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রেখে সমবায় সমিতি সংশোধন আইন-২০১২-এর খসড়া সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া সমিতির মাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালালে এই শাস্তি কার্যকর হবে।


গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বিদ্যমান আইনে এ ধরনের অপরাধের জন্য এক বছরের কারাদণ্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার বিধান ছিল।
ডেসটিনি-২০০০, যুবক, ইউনিপেটু, ডোলেন্সারসহ কয়েকটি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কম্পানির (এমএলএম) বিরুদ্ধে অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা এবং প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের অভিযোগ রয়েছে। সূত্র মতে, গতকালের মন্ত্রিসভার বৈঠকেও ডেসটিনিসহ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে মত দেন একাধিক মন্ত্রী।
আইন মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তির পর খসড়া আইনটিকে আইনে পরিণত করার প্রয়েজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদসচিব এম মোশাররাফ হোসাইন ভুঁইয়া।
সূত্র জানায়, বৈঠকে মন্ত্রিসভার সদস্যরা সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সফর নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হিলারি ক্লিনটনের কূটনৈতিক দক্ষতার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, হিলারির সফরে সরকারি ও বিরোধী উভয় দলই লাভবান হয়েছে। তবে তিনি কাকে কী পরামর্শ দিয়েছেন, একমাত্র তিনিই ভালো জানেন। হিলারির সংলাপের পরামর্শের বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংলাপকে অর্থবহ করতে হলে উভয় দলকে ছাড় দেওয়ার মনোভাব নিয়ে বসতে হবে।
সূত্র জানায়, বৈঠকে হিলারির বাংলাদেশ সফর নিয়ে দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত কার্টুনের কথা উপস্থাপন করেন এক মন্ত্রী। এরপর তাঁর সফর নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। প্রসঙ্গ উত্থাপনকারী মন্ত্রী বলেন, সংবাদপত্রে কার্টুনে এমন ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে হিলারির সফর যেন দুই দলের জন্যই লাভ। এ সফরে দুই দলই জয়ী হয়েছে। এ সময়ে প্রধানমন্ত্রী তাঁর এ বক্তব্য সমর্থন করেন।
এ ছাড়া সমবায় সমিতি সংশোধন আইন-২০১২ অনুমোদনের সময় মন্ত্রীরা ডেসটিনির বিষয়ে আলোচনা করেন। এ সময় একাধিক মন্ত্রী ডেসটিনির বিভিন্ন কার্যক্রমের নেতিবাচক দিক তুলে ধরেন। ডেসটিনির সব কার্যক্রম বন্ধেরও পরামর্শ দেন তাঁরা। অনুমোদিত আইন পাস হলে ডেসটিনি ও যুবকের মতো প্রতিষ্ঠানের অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ হবে কি না জানতে চান মন্ত্রীরা। সূত্র জানায়, এ সময় স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক মন্ত্রীদের আশ্বস্ত করে বলেন, এ আইন পাস হলে ডেসটিনি ও যুবকের মতো প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকিং ব্যবসা বন্ধ হবে।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মন্ত্রিপরিষদসচিব জানান, আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত সাপেক্ষে সংশোধনী প্রস্তাবে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এবং মন্ত্রণালয়ের মতামত পাওয়ার পর আইনের খসড়াটি পাসের জন্য জাতীয় সংসদে তোলা হবে।
অনুমোদিত খসড়া আইনে বলা হয়েছে, এটি আইনে পরিণত হওয়ার পর কেনো সমবায় সমিতির নামের সঙ্গে 'ব্যাংক', 'বিনিয়োগ' অথবা 'বাণিজ্যিক' জাতীয় পরিভাষিক শব্দ ব্যবহার করা যাবে না এবং দেশের কোথাও এর কোনো শাখাও খোলা যাবে না। যেসব স্থানে সমবায় সমিতির শাখা রয়েছে সেগুলো ছয় মাসের মধ্যে বন্ধ করার নির্দেশনাও রয়েছে খসড়ায়।
খসড়ায় কোনো সমবায় সমিতি তার সদস্যদের বাইরে কারো কাছ থেকে কোনো আমানত বা চাঁদা গ্রহণ না করার এবং কারো সঙ্গে কোনো ঋণ চুক্তি না করার বিধান রাখা হয়েছে। এই আইন অমান্য করলে সাত বছরের সাজা ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে খসড়া আইনে।
মন্ত্রিপরিষদসচিব আরো জানান, প্রস্তাবিত ও অনুমোদিত সংশোধনীতে সমবায় অধিদপ্তরের প্রধানের পদটির নাম পরিবর্তন করে 'নিবন্ধক'-এর পরিবর্তে 'মহাপরিচালক' করা হয়েছে। তবে এর পরও তিনি বিভিন্ন সমিতি নিবন্ধনের জন্য নিবন্ধকের ক্ষমতা পাবেন। আইন পাস হলে সমবায় অধিদপ্তরের জনবলকাঠামোও পুনর্বিন্যাস করা হবে বলে জানান তিনি।
মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া জানান, সমবায় সমিতি আইনে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় মাইক্রোক্রেডিট আইন এবং ব্যাংক কম্পানি আইনের প্রয়োগ করা যাবে না। এ ধরনের প্রয়োগ আইনের ব্যত্যয় বলে বিবেচিত হবে। ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে সমবায় সমিতিগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতে হবে। সমিতি শুধু তাদের সদস্যদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করতে পারবে, কোনো অসদস্যের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করা যাবে না বলেও জানান তিনি।
অনুমোদন না নিয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালানো এবং সমবায় ব্যাংক ছাড়া কোনো সমিতির শাখা খোলা হলে আইনের লঙ্ঘন হবে এবং এর জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদসচিব।
এমএলএম কম্পানিগুলোর অবৈধ ব্যাংকিংয়ের কারণেই আইনটি দ্রুত সংশোধন করা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে মোশাররফ হোসেন বলেন, বিষয়টি এমন নয়। আইনের খসড়াটি গত বছরের মার্চে এসেছে। এত দিন বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে কাজ হচ্ছিল। তবে মন্ত্রিসভার আলোচনায় ডেসটিনির বিষয়টিও এসেছে।
সূত্র জানায়, খসড়া আইনে শুধু প্রতিষ্ঠানের সদস্য ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ না করার বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে কয়েকটি খাত নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যমান আইনে একজন সদস্যের প্রতিষ্ঠানে একই পদে দুই মেয়াদে আসীন থাকতে পারার বিধার থাকলেও খসড়া আইনে দুই মেয়াদের পরিবর্তে তিন মেয়াদ করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া সমিতি অকার্যকর হলে তা গুটিয়ে ফেলার আগে পাওনাদারদের টাকা পরিশোধের বিধান রাখা হয়েছে। পাওনাদারের টাকা বাকি রেখে কোনো অবস্থায় সমবায় প্রতিষ্ঠান গুটিয়ে না ফেলার বিধান রাখা হয়েছে খসড়া আইনে। গুটিয়ে ফেললে সে ক্ষেত্রে সমবায় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ব্যক্তিগতভাবে এ টাকা পরিশোধে বাধ্য থাকবেন।
জানা যায়, মন্ত্রিসভার বৈঠকে বঙ্গোপসাগরের সাম্প্রতিক ভূতাত্তি্বক জরিপে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ ও ব্যবহারের বিষয়েও আলোচনা করা হয়। নেদারল্যান্ডসের অর্থ সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার এ জরিপ করেছে। পেট্রো বাংলাকে এসব তথ্য ও উপাত্ত সংরক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সচিব সাংবাদিকদের বলেন, এসব গোপনীয় তথ্য ও উপাত্ত সমুদ্র তলদেশের সম্পদ অনুসন্ধান এবং একাডেমিক গবেষণার কাজে ব্যবহার করা যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার নীতি নিশ্চিত করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.