সময়ের প্রেক্ষিত-তোশিরো নাকামুরার স্বপ্ন by মনজুরুল হক

শিমানে জেলার অবস্থান জাপানের প্রধান দ্বীপ হোনশুর পশ্চিমে। হিরোশিমার ঠিক উত্তরে অবস্থিত জাপান সাগরের তীরবর্তী এই জেলাটি জাপানের বাইরে তেমন পরিচিত নয়। জনসংখ্যার হিসাবে জাপানের ৪৭টি জেলার মধ্যে শিমানের অবস্থান হচ্ছে ৪৬তম।


২০০৯ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত সর্বশেষ হিসাবে শিমানের জনসংখ্যা ছিল সাত লাখের কিছু ওপরে, যার ২৮ শতাংশই হচ্ছে ৬৫ বছর কিংবা বেশি বয়সী লোকজন। জনসংখ্যার অনুপাতিক হারে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধ লোকজনের বসবাসও শিমানে জেলাতেই। এর অন্যতম একটি কারণ অবশ্যই হচ্ছে, অর্থনৈতিক মন্দার মুখে কাজের সুযোগ সীমিত হয়ে আসায় তরুণ প্রজন্মের আশপাশের বড় শিল্পাঞ্চলগুলোয় চলে যাওয়া। ফলে তরুণ প্রজন্মকে অঞ্চল ছেড়ে চলে না যাওয়ায় উৎসাহিত করতে নানা রকম পদক্ষেপ স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকেও নিতে হচ্ছে।
জেলার ঠিক মধ্যাঞ্চলে পাহাড় ঘেরা এক উপত্যকায় গড়ে উঠেছে প্রাচীন শহর ওদা। ষোড়শ শতকে শহরটি ছিল সমৃদ্ধ এক জনপদ। ইওয়ামি গিনজান রৌপ্য খনি সেখানে নিয়ে আসে বিত্ত ও সমৃদ্ধি। চতুর্দশ শতকের শুরুতে রুপার খনির সন্ধান পাওয়া গেলেও গৃহযুদ্ধকবলিত জাপানে পরবর্তী প্রায় ৩০০ বছর প্রভাবশালী বিভিন্ন সামন্ত প্রভুদের মধ্যে চলা যুদ্ধে খনির মালিকানার হাতবদল প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সপ্তদশ শতকের শুরুতে তোকুগাওয়া সামন্ত প্রভুর নেতৃত্বে জাপানের একীভূতকরণ চূড়ান্ত আকার নেওয়ার পর ইওয়ামি গিনজান রুপার খনির মালিকানাও শোগুন আধিপত্যের হাতে চলে আসে। সেই সময়টা ঘটনাক্রমে হয়ে উঠেছিল এশিয়াজুড়ে রুপার সমৃদ্ধির সময়। ইওয়ামি রৌপ্য খনির জন্য সময়টা তাই হয়ে ওঠে সমৃদ্ধির সবচেয়ে ভালো সময়। রুপার চাহিদা মেটানোর জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়ে আসা খনিশ্রমিকদের কল্যাণে ওদা শহর ও এর আশপাশের ওমরি অঞ্চল ক্রমশই জনবসতিপূর্ণ এক এলাকায় পরিণত হয়। তবে রুপার সেই সমৃদ্ধির সময় দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়নি। ১৬০২ সালে চাহিদা সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকার সময় ইওয়ামি খনির বার্ষিক উৎপাদন ছিল ১৫ টন। তবে বিনিময় মুদ্রার অবস্থান থেকে রুপার স্থানচ্যুতির ফলে এশিয়াজুড়ে রুপার চাহিদা আবারও পড়ে যাওয়া ধীরে ধীরে উৎপাদন কমাতে হয়। ইওয়ামি রৌপ্য খনি পরবর্তী সময়ে আরও প্রায় সাড়ে ৩০০ বছর ধরে সক্রিয় থেকে গেলেও খনিভিত্তিক শহর ওদার ক্রমশ জনশূন্য হয়ে পড়ার প্রবণতার শুরু তখন থেকেই। যে পথ ধরে দীর্ঘ যাত্রার শেষে অতীতের সমৃদ্ধ সেই জনপদে বর্তমানে জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪০০ জনে।
জনসংখ্যার ক্রমশ পতনমুখী ধারা হচ্ছে জাপানের দূরবর্তী বিভিন্ন মফস্বল শহরের মোকাবিলা করতে হওয়া সার্বিক এক সমস্যা। জাপান সরকার যে এ বিষয়ে সচেতন, সরকারের গ্রহণ করা সাম্প্রতিক নানা রকম পদক্ষেপ তার প্রমাণ তুলে ধরছে। স্থানীয় পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে সহায়তা করা হচ্ছে সরকারের সে রকম একটি পদক্ষেপ, শিমানে জেলাও সার্বিকভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তা পেয়ে আসছে। তবে সরকারের নেওয়া সে রকম উদ্যোগের বাইরে স্থানীয়ভাবে নিজস্ব প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ওদা শহরকে আবারও প্রাণবন্ত করে তোলায় ব্যতিক্রমী ভূমিকা পালন করে যাওয়ার মধ্য দিয়ে জাপানের সংবাদ মাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণে যিনি সক্ষম হয়েছেন, তিনি হলেন শহরের সফল ব্যবসায়ী তোশিরো নাকামুরা। ওদা শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নাকামুরার ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড এখন জাপানের রাষ্ট্রীয় সীমানার গণ্ডি অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায়। যা কিনা অন্যভাবে শহরে নিয়ে এসেছে নতুন এক প্রাণচাঞ্চল্য।
ওদা শহর হচ্ছে নাকামুরা পরিবারের কয়েক পুরুষের আদি নিবাস। প্রায় ২০০ বছর আগে পরিবারের এক পূর্বপুরুষ ইওয়ামি খনি এলাকায় বসতি গড়ে কামারের পেশায় নিয়োজিত হয়েছিলেন। তোসিরো নাকামুরার জন্ম ১৯৪৮ সালে পাহাড় ঘেরা দূরবর্তী সেই মফস্বল শহরে। স্কুলের লেখাপড়া শেষ করে নাকামুরা শুরুতে জাপানের কিওতো শহরে ও পরে যুক্তরাষ্ট্রে কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন ও বিকলাঙ্গতার চিকিৎসা বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। ২৬ বছর বয়সে দেশে ফিরে আসার পর নিজের শহর ওদাতেই তিনি দেশে ও বিদেশে লাভ করা শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে সেই শিক্ষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হন। নাকামুরা ব্রেইসের উৎপত্তি সেখান থেকেই। ১৯৭৪ সালে ওদা শহরে পৈতৃক নিবাসের সামনে মাত্র ৩৩ বর্গমিটার জায়গায় কৃত্রিম দেহাঙ্গ তৈরির কারখানা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে বাণিজ্যের জগতে নাকামুরার প্রবেশ। নগরকেন্দ্রিক কারখানা গড়ে তোলার প্রবণতায় সাড়া না দিয়ে কেন তিনি দূরবর্তী এক মফস্বল শহরকে বেছে নিয়েছিলেন, সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানিয়েছেন যে নিজের শুরু করা সেই ব্যবসার মধ্য দিয়ে ক্রমশ পিছিয়ে পড়া এক জনপদকে আবারও সজীব করে তোলার চিন্তা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং নিজের সেই আদি পৈতৃক নিবাসের জনশূন্য হয়ে পড়া বন্ধ করতে কিছু একটা তিনি করতে চেয়েছিলেন। তোশিরো নাকামুরার বাবা প্রায়শই আক্ষেপ করে বলতেন, একসময়ের বিশ্বখ্যাত রুপার খনির শহর এখন ভুতুড়ে এক শহরে পরিণত হচ্ছে। বাবার সেই আক্ষেপ তোশিরোকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছিল এবং শহরের জন্য কিছু একটা করতে পারার বাসনা নিয়ে শেষ পর্যন্ত সেখানেই কারখানা তৈরির সিদ্ধান্ত তিনি নেন।
ক্ষুদ্র সেই পরিসরে যাত্রা শুরু করা নাকামুরা ব্রেইসের বার্ষিক বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ এখন দাঁড়িয়েছে কয়েক কোটি মার্কিন ডলারে। কৃত্রিম হাত, পা, আঙুল ও স্তন তৈরির দিক থেকে কোম্পানি এখন বিশ্বের প্রধান একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত, যা কিনা নাকামুরার নিজের জন্য এনে দিয়েছে বিত্তের বৈভব, যার অনেকটাই তিনি আবার খরচ করছেন শহরের প্রাচীন বিভিন্ন ভবন ও বাড়িঘর সংরক্ষণে। বিশ্বজুড়ে ব্যবসা বিস্তৃত হলেও নাকামুরা এখনো নিজ শহরের সাধারণ পৈতৃক নিবাসে বসবাস করছেন এবং তাঁর কোম্পানির সদর দপ্তরও ওদা শহরেই রয়ে গেছে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ওদা শহরের জনসংখ্যা ৪০০-এর সামান্য বেশি। ৪০০ জনসংখ্যার সেই শহরের ৬৫ জন বর্তমানে নাকামুরা ব্রেইসে কর্মরত। শুধু তাই নয়, তরুণরা যেন শহর ছেড়ে চলে না যায়, তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় তরুণদের চাকরিতে নিয়োগ দেওয়ায় নাকুমুরা ব্রেইস বিশেষভাবে তৎপর। কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ের ৬৫ জন কর্মীর গড় বয়স হচ্ছে ৩৩ বছর।
ব্যবসায়িক সাফল্য তোশিরো নাকামুরাকে সমাজের অন্যান্য সমস্যা সমাধানে তৎপর হতে উৎসাহিত করছে এবং ওদা শহর ও ওমোরি অঞ্চলকে পর্যটক আকর্ষণকারী এক কেন্দ্রে পরিণত করে নেওয়ার লক্ষে নানা রকম কাজ তিনি করে চলেছেন।
ওদা শহরে নাকামুরা ব্রেইসের অতিথি আপ্যায়ন ভবনে কিছুদিন আগে এক আলাপচারিতায় নিজের নতুন এক বাসনার কথা তোশিরো নাকামুরা আমাকে জানালেন। সেই বাসনা হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র লোকজনের দুর্দশা লাঘবে কিছু একটা করতে পারা। সেই একই ভবনে নাকামুরা ব্রেইসের চিকিৎসাকলা গবেষণা কেন্দ্র অবস্থিত। কৃত্রিম দেহাঙ্গকে কীভাবে সহজে ব্যবহার উপযোগী ও দেখতে ঠিক মূল দেহাঙ্গের মতো করে তৈরি করে নেওয়া যায়, সেই গবেষণা কেন্দ্রে চালানো হচ্ছে। কোম্পানির তৈরি কৃত্রিম একটি পা দেখিয়ে নাকামুরা বললেন, সিলিকনের প্রলেপ দেওয়া সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি সংযুক্ত সে রকম একটি পায়ের বাজারমূল্য ১০ লাখ ইয়েনের বেশি। সে রকম উচ্চমূল্য যে দরিদ্র জনগণের ধরাছোঁয়ার বাইরে, সেই চিন্তা প্রায়শই তাঁকে তাড়িত করে। সস্তায় কীভাবে কৃত্রিম দেহাঙ্গ তৈরি করে নেওয়া যায়, সেই গবেষণাও তাই তাঁর প্রতিষ্ঠান চালিয়ে যাচ্ছে। গবেষণার একটি ফলাফলও তিনি সেখানে রেখেছিলেন, যেটা হচ্ছে কাঠের তৈরি খুবই সাধারণ একটি কৃত্রিম পা, যার ভেতরের আস্তরনে দামি সিলিকন ব্যবহার না করে সাধারণ বস্ত্র কাজে লাগানো হয়েছে। কাঠের সেই নমুনাটি তৈরি করেছেন স্থানীয় একজন প্রতিবন্ধী। ফলে বিশ্বের যেকোনো অঞ্চলের কাঠের কারিগরদের পক্ষে সে রকম কিছু তৈরি করে নেওয়া অসম্ভব মোটেও নয়।
তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে দুর্ঘটনা কিংবা হানাহানিতে পা হারিয়ে ফেলা যে চিরদিনের জন্য ভয়ংকর এক দুরবস্থায় দরিদ্র মানুষজনকে ফেলে দিতে পারে, সে বিষয়ে নাকামুরা অবগত। তাঁদের জন্য কিছু একটা এখন তিনি করতে চাইছেন এবং সেই আশা নিয়ে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের দিকেও তিনি তাকিয়ে। প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানে নাকামুরা ব্রেইস প্রস্তুত। তবে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানকে বিষয়টি ঠিক গতানুগতিক ব্যবসা হিসেবে না দেখে বরং জনকল্যাণে নিয়োজিত সামাজিক ব্যবসা হিসেবে দেখতে হবে, যে ধারণা আমাদের গ্রামীণ ব্যাংকের কর্ণধার অধ্যাপক ইউনূস বিশ্বজুড়ে প্রচার করে আসছেন। ফলে সেই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংযোগ গড়ে ওঠা মনে হয় নতুন এক আশা বিশ্বের অবহেলিত প্রতিবন্ধীদের মনে জাগিয়ে তুলতে পারে এবং নাকামুরা ব্রেইসের সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে এশিয়া অঞ্চলজুড়ে সস্তার কৃত্রিম পা সরবরাহের এক কেন্দ্রে।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.