স্কট শ্যায়ার ও অ্যালেন কাওয়েল-শরণার্থীরা মাথা গোঁজার ঠাঁই চায়

হাজার হাজার শ্রমিক লিবিয়া ছাড়ছেন। সেখানকার দাঙ্গা তাঁদের দেশত্যাগে বাধ্য করছে। তিউনিসিয়ার রাস আসদির সীমান্তে তাঁদের জড়ো হতে দেখা যায়। সীমান্ত চৌকিগুলো ইতিমধ্যে ফাঁকা ও পরিত্যক্ত মনে হতে থাকে। মার্চের ৩ তারিখ বিকেলের কথা। বালুঝড় বইছিল তখন।


অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে পেঁৗছায় যে তাঁদের মনে হতে থাকে, এই একটি রাত বোধ হয় তাঁদের পক্ষে পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। আবার আশায় আশায় তাঁদের সময় অতিবাহিত হচ্ছিল। মনে করছিলেন, এ রাতেই বোধ হয় তাঁরা অবশ্যই মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করে নিতে পারবেন। এমন সময় একটা বাস এসে থামে তাঁদের কাছাকাছি। দরজাও খুলে যায়। হুড়োহুড়ি করে তাঁরা বাসে উঠতে শুরু করেন। নারী-পুরুষ আছেন। আছে শিশুও। সঙ্গে থাকা কাপড়চোপড় ও জরুরি জিনিসপত্র বোঝাই সুটকেসগুলোও জায়গা করে নেয় বাসের ভেতরে।
আন্তর্জাতিকভাবে শরণার্থীদের সরিয়ে আনার জন্য বিমানবহর কাজ করছে। সরকার এবং বিভিন্ন সাহায্য সংস্থাও শরণার্থীদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে একান্তই মানবিক কারণে। কিন্তু শরণার্থীদের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত বাসের কোনো ব্যবস্থা হয়নি এখনো। ফলে উড়োজাহাজে করে যারা নিজ ভূমির দিকে যেতে পারছে, তাদের অতি ভাগ্যবান হিসেবে অবশ্যই বর্ণনা করতে হবে। তিউনিসিয়া সীমান্তে হাজার হাজার শরণার্থী, যারা প্রত্যাবাসনের জন্য অপেক্ষা করছে, তাদের জন্য প্রয়োজনীয় তাঁবু নেই, খাবারের জোগাড়ও পর্যাপ্ত নয়। এত মানুষ, কিন্তু সেখানে পয়ঃব্যবস্থা খুবই নাজুক।
জাতিসংঘ শরণার্থী-বিষয়ক হাইকমিশনার অ্যান্টনিও গাটারস বলেছেন, অনেক শ্রমিক লিবিয়া ছেড়ে তিউনিসিয়ায় এসেছেন। কিন্তু তাঁদের সামনে এই মুহূর্তে বড় সমস্যা হচ্ছে থাকার জায়গা, যাকে স্বপ্নের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
ডাকাতের কবলে পড়ছেন শরণার্থীরা। 'আমার ভাগ্য প্রসন্ন এমন বলার কোনো সুযোগ নেই।' এমন কথা বলেছেন ৩৩ বছর বয়সী বাংলাদেশি এক নির্মাণশ্রমিক রিপন দাস, যিনি ত্রিপোলি ছেড়েছেন তিন দিন আগে। দুই রাত তিনি কাটিয়েছেন তিউনিসিয়ার ওপারে। এ দুই রাত ছিলেন তিনি খোলা আকাশের নিচে। ওই সময় ডাকাতদলের কবলে পড়েন তিনি। ধারালো ছুরি নিয়ে আক্রমণ করা হয় তাঁকে। ডাকাতরা তাঁর টাকা-পয়সা নিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, ওরা তাঁর সেলফোনটিও নষ্ট করে ফেলে। তিনি এখনো জানেন না, কিভাবে তিনি দেশে যেতে পারবেন।
তিউনিসিয়াতে দীর্ঘদিন পর্যন্ত অস্বাভাবিক পরিস্থিতি চলছে। সেখানেও বিদ্রোহ হয়েছে। তেমনি পরিস্থিতিতে শরণার্থীদের ব্যাপক চাপ দেশটির জন্য বিব্রতকরই হয়েছে। সংখ্যার দিক থেকেও এটা কম নয়। এক লাখ ৮০ হাজার শরণার্থীর অর্ধেকেরও বেশি এসেছে তিউনিসিয়ায়।
রাজ আসদির সীমান্ত থেকে চার কিলোমিটার দূরে একটি শরণার্থী শিবির খোলা হয়েছে। কিন্তু সেটিও শরণার্থীদের সমপূর্ণ চাপ সয়ে নেওয়ার মতো নয়। মাত্র ১০ হাজার মানুষের থাকার ব্যবস্থা আছে সেখানে। এই মুহূর্তে ওই শিবিরেই ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার শরণার্থী অবস্থান করছে। আন্তর্জাতিক একটি স্বাস্থ্য সংস্থার অভিমত অনুযায়ী, এখনো লিবিয়ায় হাজার হাজার শ্রমিক রয়ে গেছেন। ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্র সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। কিন্তু সেই সাহায্য এখনো পথে রয়েছে। শরণার্থীদের অধিকাংশই এসেছে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে। এভাবে শরণার্থীর জীবন বেছে নেওয়ার পেছনে তাদের কোনো অপরাধ রয়েছে কি না তা তারা আজও জানতে পারেনি।
শরণার্থীদের সার্বিক সহযোগিতার সুযোগ পেতে পেতে আরো বেশ কিছু সময় লাগবে। কিন্তু এর মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়ে দিয়েছে যে শরণার্থী শিবিরে মহামারি আকারে রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেখানে যেসব সেবাকর্মী কাজ করছেন, তাঁরা মাস্ক পরে নিয়েছেন। হাতেও গ্লাভস লাগিয়ে নিয়েছেন। যাঁরা ইতিমধ্যে এখানে আসতে পেরেছে, তারা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করছে; কিন্তু তারাও জানে না, কী পরিমাণ মানুষ এখনো লিবিয়ায় রয়ে গেছে।
বেশ কিছুদিন ধরে লিবিয়াতে এই গোলযোগ চলার কারণে বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা সেখানে কাজ করার জন্য পরিকল্পনা নিয়েছে। তাদের এ পরিকল্পনাও দীর্ঘমেয়াদি। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার মতে, তিউনিসিয়ায় যে শরণার্থী এসেছে, তাদের খাবার-দাবারের জন্য এই মুহূর্তে ৩৮.৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন। তাদের হিসাব মতে, এই টাকা ব্যয় হবে ২.৭ মিলিয়ন শরণার্থীর জন্য। ইউরোপীয় ইউনিয়ন লিবিয়া থেকে আসা এসব শরণার্থীর জন্য ৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান ঘোষণা করেছে। বেশ কিছু দেশ ইতিমধ্যে সেসব শ্রমিককে নেওয়ার কথাও জানিয়েছে। এসব শরণার্থীর মধ্যে অনেকেই আছে মিসরীয়। তারা ত্রিপোলি থেকে পশ্চিমে পাড়ি দিয়েছে বাঁচার আশায়।
লেখকদ্বয় : সাংবাদিক
দ্য হিন্দু থেকে ভাষান্তর : মোস্তফা হোসেইন

No comments

Powered by Blogger.