গারোটিলায় একদিন by প্রনীত রঞ্জন দেবনাথ

কমলগঞ্জে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর গারো জনগোষ্ঠী একটি। কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নের পাত্রখোলা চা বাগানের দূরত্ব কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটারের মতো। উপজেলার দক্ষিণে অবস্থিত গারোটিলায় আদিবাসী নৃজনগোষ্ঠীকে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে কমলগঞ্জের বিশিষ্ট লেখক-গবেষক আহমদ সিরাজকে
সঙ্গী করে গত ২৪ মে দুপুর ২টার দিকে মোটরসাইকেলযোগে ভানুগাছ বাজার থেকে রওয়ানা দিলেও পথে পথে বৃষ্টির দাপট থেকে রক্ষা পেতে আশ্রয় নিতে হয়েছে আস্তানায়। এভাবে পাত্রখোলা চা বাগানে পেঁৗছতে গিয়ে ৩টা বেজে যায়। বাগানে প্রবেশ করে প্রায় ৪ কিলোমিটার পশ্চিম-উত্তর কৌণিক দূরত্বে পাহাড়ি টিলায় গারোদের বসবাস। এলাকাটি দুর্গম হলেও নিস্তরঙ্গ জনপদের এমন একটি পাহাড়ি এলাকায় পেঁৗছতে গিয়ে একটা রোমাঞ্চকর অভিযাত্রার স্বাদ মুগ্ধ করেছিল। পাহাড়ে গারোদের টিলায় আমাদের পেঁৗছতে বিকেল সাড়ে ৩টা বেজে যায়। এই গারো টিলাভূমিতে ৭২টি পরিবার বসবাস করছে। লোকসংখ্যার হিসাবে নারী-পুরুষ প্রায় চারশ'। এখানে ১৯৬৫ সালের দিকে আসেন তাদের পূর্বপুরুষরা। এর আগে তাদের আদি অবস্থান ময়মনসিংহের সুসং দুর্গাপুর, নেত্রকোনা, বিশী অঞ্চল ইত্যাদিতে। খ্রিস্টান ফাদার বা পাদ্রি তাদের এখানে নিয়ে আসেন। নিগূঢ় এই জঙ্গলটি তারা বসবাস ও উৎপাদনের উপযোগী করে তোলেন। তাদের পূর্বপুরুষ খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করায় এখানে সবাই খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। এখানে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টান দুটি ভাগ আছে। গারোরা জুম চাষ করে থাকলেও এখানে তারা ন্যাশনাল টি কোম্পানির আওতাধীন পাত্রখোলা চা বাগানের কোম্পানির লোক। চা বাগানের শ্রমিক হিসেবে দৈনিক ৪৮ টাকা মজুরিতে কাজ করেন। গারোটিলার প্রায় ১০০ লোক পাত্রখোলা চা বাগানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। গারো ভিন্ন ধর্মে দীক্ষিত হলেও তাদের সমাজ চলে মাতৃতান্ত্রিক নিয়মে। মা পরিবারের প্রধান ও সম্পত্তির মালিক হিসেবে বিবেচিত। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিপ্রিয় এই জনগোষ্ঠীর অনেক কিছুই এখন তছনছ হয়ে পড়েছে।
বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়নের সুবাতাস সর্বত্রই বইতে শুরু করেছে বলে উচ্চারণ থাকলেও এই গারোটিলায় ছোঁয়া লাগেনি। এখানে বিদ্যুতের কোনো ব্যবস্থা নেই। পুরো গারোটিলা রাতে গভীর অন্ধকারে ডুবে থাকে। এখানে রয়েছে বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব। হাতেগোনা দু'তিনটি টিউবওয়েল রয়েছে। স্যানিটেশন ব্যবস্থাও ভালো নয়। শিক্ষার ক্ষেত্রে একটিমাত্র বেসরকারি মিশনারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। এখানে চলাচলের অবস্থা নাজুক। রাস্তাঘাটের অভাব রয়েছে। এখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানসহ জীবনের সব মৌলিক বিষয়ে গারোটিলার মানুষরা বঞ্চিত হয়ে পড়েছে। প্রায় ৪০০-এর কাছাকাছি নারী পুরুষের মাঝে মাত্র দু'জন এসএসসি ও ৬ জন এসএসসি পাসের তথ্য মেলে।
পাত্রখোলা চা বাগানের গারোটিলার দুঃসহ জীবনযাত্রার মধ্যেও তাদের অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য ভুলে থাকতে নারাজ। যদিও অন্য ধর্ম গ্রহণের কারণে চর্চার অভাবে, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এগুলোর অনেকখানি স্মৃতির অংশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে, তবু এখানে গারো তরুণ-তরুণীরা গড়ে তুলেছেন সাংস্কৃতিক ক্লাব। তারা উৎসব অনুষ্ঠানে গারো ভাষায় গান ও নৃত্য করে থাকেন। এগুলোর মধ্যে আছে, যেমন_ 'খুশি হঙা নাসি সাংনি, দা আলো (আনন্দের নৃত্য), খ্রী যো ফান্ডে বাং ভ্রা বো ম্যা থ্রা রাং (দলীয় নৃত্য), রে রে গান ইত্যাদি। এগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের প্রয়োজনীয় বাদ্যযন্ত্রের যেমন অভাব আছে, তেমন ঐতিহ্যবাহী পোশাকেরও। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি বিকাশ, রক্ষায় উদ্যোগ ও সরকারি টেন্ডারের বিরাট আয়োজনের খবর মিললেও এখানে চিহ্ন পড়েনি। বিস্মিত হতে হয় যখন জানা যায়, এই গারোটিলায় উচ্চ পর্যায়ের কোনো জনপ্রতিনিধি পদার্পণ করেননি, তেমনি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের। গবেষক আহমদ সিরাজের মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বাইরে প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক ধারার এমন একটা জনগোষ্ঠী এখানে কঠোর দরিদ্রতার মধ্যে জীবন অতিবাহিত করছে; এমন ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী জনগোষ্ঠী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা থেকে উপেক্ষিত হচ্ছে। তাতে যে কেউ সরকারের কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। এমন জনগোষ্ঠী সংস্কৃতি ও বস্তুগত উন্নয়নে সরকারের দ্রুত এগিয়ে আসা বাঞ্ছনীয়।
pronithnath@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.