আলাওলের পুনর্জন্ম by রাজীব নন্দী

'প্রেম বিনে ভাব নাই ভাব বিনে রস ত্রিভুবনে যাহা দেখি প্রেম হুনতে (হতে) বশ' যুগে যুগে টিকে আছে 'পদ্মাবতী'র রচয়িতা মহাকবি আলাওলের ঐতিহাসিক প্রণয় উপাখ্যান। কিন্তু হারিয়ে গেছে আলাওল। হারিয়ে গেছে বললে ভুল হবে। আলাওল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছেন। চিতোরের রানী পদ্মিনীর যে কাহিনী বাঙালির সাহিত্য মানসে জুগিয়েছে সমৃদ্ধির পালক সেই আলাওল নিজভূমে পরবাসী।


বলা হয়ে থাকে, বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে ধর্মীয় ভাবগণ্ডিকে পেরিয়ে রোমান্সের ধারা সূচনাকারী হিসেবে আলাওল মুসলমান কবিদের মধ্যে অন্যতম। কবিকুলের মধ্যে বিচিত্র মেধা ও সাহিত্য প্রতিভার এই কবি নিজ গুণেই স্থান করে নিয়েছেন আরাকান রাজসভার অন্যতম কবি হিসেবে। আজও তাকে আমরা জানি মধ্যযুগের সেরা কবি হিসেবে। আজ আর সেই আলাওলের স্মৃতিবিজড়িত দীঘি নেই। এলাকাবাসীও দাবি তুলছে না সংস্কারের। কিন্তু প্রতিবার গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পথে আলাওলের দীঘি পেরোবার সময় মনে পড়ে দীঘির মতোই হারিয়ে যাবেন বলেই কি জন্মেছিলেন আলাওল? চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী মহাসড়কের আলাওল দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম পাড়ে সড়কের মাঝখানে ও সড়কের পাশে গর্তগুলোর কারণে একটি বাস আরেকটির পাশ কাটাতে পারে না। মহাসড়কে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট।
প্রায় বিস্মৃত আলাওলকে স্মরণ করতে উদ্যোগ নেওয়ার খবর এসেছে। বহুদিন পর এই খবরটি শুনে ভালো লাগল। আগামী ২৬ মে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনব্যাপী উৎসবের মাধ্যমে আলাওলকে স্মরণ করা হবে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চবির নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ড. সৌরেণ বিশ্বাস জানিয়েছেন, সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় চবিতে দিনভর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে। আর্থিক ব্যবস্থাপনারও দায় নিয়েছে সরকার। 'দিতে হবে, দিতে হবে' বলে স্লোগানে স্লোগানে রাজপথ কাঁপিয়েদের জন্য এ যেন মেঘ না চাইতেই জল। তবে সেই জল কতটুকু গড়াবে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তরিকতার ওপর নির্ভর করবে।
ড. সৌরেণ বিশ্বাস কিছুদিন আগে আমাকে আশ্বস্ত করেছেন 'জল গড়াবে গন্তব্য পর্যন্ত'। ইতিমধ্যে আলাওলের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে একটি সংক্ষিপ্ত প্রকাশনা বের করার প্রস্তুতি চলছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মধ্যযুগের সাহিত্য গবেষকদের মিলনক্ষেত্র হবে সেদিন। দুপুরে থাকবে আলাওলের পুঁথিপাঠ। সন্ধ্যা নামতেই মঞ্চে আসবে পদ্মাবতীর অংশবিশেষ নিয়ে নাটিকা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম আরিফ জানান, চবিতে আলাওল হল নামে আবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য একটি ছাত্র হল আছে। এছাড়া পদ্মাবতী আলাওলের সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা। যেখানে কাব্যিক আবেগের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার মিশেল আলাওলকে পরিণত করেছে 'পণ্ডিতকবি' হিসেবে। তাই তাকে আমাদের এই স্মরণ।
আলাওলের জন্মসাল সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। ধরা হয় আনুমানিক ১৬০৭ সালে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের জোবরা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। অভিজাত পরিবারের সন্তান হিসেবে আলাওল বাল্যকালেই বাংলা, সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষা রপ্ত করেন। জনশ্রুতি আছে, যুদ্ধবিদ্যা আর সঙ্গীতকলা দুটিতেই তিনি ছিলেন সব্যসাচী। কবিপ্রতিভার স্ফুরণে তিনি আরাকানের রাজসভায় স্থান করে নেন। আনুমানিক ১৬৫৯-৬০ সালে রোসাঙ্গ রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যুক্ত থাকার অভিযোগে আলাওল দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন। আলাওল যখন কারাপ্রকোষ্ঠে তখন অর্থকষ্টে ভিক্ষাবৃত্তি করে সংসার চালিয়েছেন স্ত্রী-পুত্ররা। আলাওলের অমর সৃষ্টি হচ্ছে পদ্মাবতী, সতীময়না-লোরচন্দ্রাণী, সয়ফুলমুলক বদিউজ্জামান ও সিকান্দরনামা। সৃজন করেছেন তিনি অমরকাব্য সঙ্গীতবিষয় রাগতালনামা।
নারী-পুরুষের সম্পর্কে আজ যখন কেবলই সন্দেহ, প্রতারণা আর লোভ, সেই দুঃসময়ে নিবিড় প্রেমের কবি আলাওলকে স্মরণ নিশ্চয় 'সাধুবাদ'। আলাওলকে স্মরণের খবর আর উদ্যোগের কথা শুনেই অর্ধেক তৃপ্তি লাভ করলাম। এখন অপেক্ষায় আছি অনুষ্ঠানের দিনটির জন্য। জন্মস্থানে প্রায় বিস্মৃত আলাওলের পুনর্জন্ম হোক!
 

No comments

Powered by Blogger.