উপমহাদেশ-পাকিস্তানে গণতন্ত্রের সংগ্রাম by হামিদ মীর

সংবিধানের অষ্টাদশ সংশোধনী বিল পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এটা অনেকটাই শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার মতো। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিব একটি ফেডারেল পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা ও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়েছিলেন।


কিন্তু তাঁর সে দাবি মানা হয়নি, বরং উল্টো তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করা হয়েছিল। একজন সামরিক স্বৈরশাসকের নির্দেশে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করা হয়েছিল; তার চূড়ান্ত ফল হয়েছিল পাকিস্তানের ভাঙন।
সংবিধানের অষ্টাদশ সংশোধনী বিলে শুধু তাদেরই রাষ্ট্রদ্রোহী বলা হয়নি, যারা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সংবিধান রদ করবে; বরং যদি কোনো আদালত অভ্যুত্থানকে বৈধ বলে ঘোষণা করেন, তবে সেটাও রাষ্ট্রদ্রোহ বলে গণ্য হবে। এই নতুন বিলে প্রদেশগুলোকে অনেক নতুন অধিকার দেওয়া হয়েছে। মজার বিষয় হলো, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে সাংবিধানিক কমিটিতে লড়েছেন সিনেটর আবদুল মালিক বালুচ ও সিনেটর আফরাসিয়াব খাট্টাক, যাঁদের পূর্বসূরিরা ১৯৭০ সালে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের মিত্র। ১৯৭০ সালে শেখ মুজিবকে স্বায়ত্তশাসন দিলে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা পেতে পারত।
অষ্টাদশ সংশোধনীর ব্যাপারে মতৈক্য অবশ্যই সব রাজনৈতিক দলের মিলিত বিজয়। তবে দুই বড় দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ও পাকিস্তান মুসলিম লিগ (এন) চার্টার অব ডেমোক্রেসিতে (সিওডি) যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেগুলোর কয়েকটি সত্যিকার অর্থে পূরণ করতে পারেনি। সিওডির মূল লক্ষ্য ছিল ১৯৭৩ সালের সংবিধান অনুযায়ী সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ফিরিয়ে দেওয়া, প্রেসিডেন্টের পদটিকে নিছক আলংকারিক বিষয়ে পরিণত করা। কিন্তু অষ্টাদশ সংশোধনীর বিল এ লক্ষ্যে পেশ করা হয়নি। এখনো প্রেসিডেন্ট মোটেই খোঁড়া হাঁস নন। জারদারি মোটেও সাবেক প্রেসিডেন্ট চৌধুরী ফজল এলাহির মতো আলংকারিক প্রেসিডেন্ট নন। তাঁর হাতে এখনো অনেক ক্ষমতা আছে, সিওডি অনুযায়ী যেগুলো থাকার কথা নয়।
চার্টার অব ডেমোক্রেসি বা সিওডি সনদটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২০০৬ সালে বেনজির ভুট্টো ও নওয়াজ শরিফের মধ্যে। গত শুক্রবার ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে সিনেটর রাজা রাব্বানি সংবিধানের অষ্টাদশ সংশোধনীর যে বিল পেশ করেছেন, তাতে সিওডি সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়নি। সিওডির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি বা প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরী—কারোর স্বার্থের অনুকূলেই যেত না। বাস্তবায়ন না হওয়ায় প্রেসিডেন্ট ও প্রধান বিচারপতি উভয়েই লাভবান হয়েছেন। সংবিধান সংস্কার কমিটি সিওডির প্রথম ধারার লঙ্ঘন ঘটিয়ে প্রেসিডেন্টের হাতে কিছু ক্ষমতা রেখে দিয়েছে। সিওডির প্রথম ধারায় বলা হয়েছে: ‘১৯৭৩ সালের সংবিধান ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর সামরিক অভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায় পুনঃপ্রবর্তিত হবে, যাতে থাকবে যুক্ত ভোটের বিধান এবং সংখ্যালঘু ও নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের বিধান।’
১৯৭৩ সালের প্রকৃত সংবিধান ও চার্টার অব ডেমোক্রেসির দ্বিতীয় ধারা অনুযায়ী গভর্নর, তিন বাহিনীর প্রধানদের ও কেন্দ্রীয় সুুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নিয়োগ দেবেন প্রধান নির্বাহী। সাংবিধানিক কমিটি সিওডির দ্বিতীয় ধারার মূল চেতনা বাস্তবায়নে সম্মতি দেয়নি। অষ্টাদশ সংশোধনীর বিলে সংবিধানের ১০১ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘প্রতিটি প্রদেশে একজন করে গভর্নর থাকবেন, যাঁরা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নিযুক্তি পাবেন।’
নতুন বিল অনুযায়ী প্রেসিডেন্টই সশস্ত্র বাহিনীগুলোর সুপ্রিম কমান্ডার থাকছেন এবং ‘প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে কেন্দ্রীয় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ও তিন বাহিনীর প্রধানদের নিয়োগ দেবেন।’ অষ্টাদশ সংশোধনীর বিলের মাধ্যমে গভর্নর ও তিন বাহিনীর প্রধানদের নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের বিশেষ ক্ষমতা খর্ব হবে, কেননা এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ বাধ্যতামূলক। কিন্তু এই নতুন প্রস্তাবিত সংশোধনীও চার্টার অব ডেমোক্রেসির একটি লঙ্ঘন। কারণ, গভর্নর ও তিন বাহিনীর প্রধানদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ ক্ষমতা থেকে যাচ্ছে প্রেসিডেন্টের হাতেই। জানা গেছে, সিনেটর রাজা রাব্বানি প্রেসিডেন্ট জারদারির সঙ্গে বিশদ পরামর্শ করেছেন এবং প্রেসিডেন্টের হাতে কিছু ক্ষমতা রেখে দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির সম্মতিক্রমেই।
চার্টার অব ডেমোক্রেসির তৃতীয় ধারায় বলা হয়েছে, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে সুপারিশ করবে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন একটি কমিশন। এমন একজন প্রধান বিচারপতি সেই কমিশনের প্রধান হবেন, যিনি কখনো প্রভিশনাল কনস্টিটিউশনাল অর্ডার বা অস্থায়ী সাংবিধানিক আদেশের অধীনে শপথ নেননি। এ ধারার আলোকে বিচারপতি ইফতিখার তেমন জুডিশিয়াল কমিশনের প্রধান হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না, কারণ তিনি ২০০৮ সালে অস্থায়ী সাংবিধানিক আদেশের অধীনে শপথ নিয়েছিলেন। কিন্তু অষ্টাদশ সংশোধনীর বিলে তাঁর ক্ষেত্রে এ বিষয়ে ছাড় দেওয়া হয়েছে। চার্টার অব ডেমোক্রেসি লঙ্ঘন করে তিনি জুডিশিয়াল কমিশনের প্রধান হতে পারেন।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অষ্টাদশ সংশোধনীর বিলে সংবিধানের ৬২ ও ৬৩ অনুচ্ছেদে কিছু পরিবর্তনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন অর্ডার (এনআরও) মামলায় সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়ের আলোকে। এনআরও মামলায় সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া বিশদ রায়ে সংবিধানের ৬২(এফ) ও ৬৩(১) এইচ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট বলেছিলেন, ৬২(এফ) অনুচ্ছেদটি সংবিধানে ঢোকানো হয়েছে একজন স্বৈরশাসকের হাতে এবং তা এখনো বলবত্ আছে। তারপর পাঁচটি ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ও সিনেট নির্বাচিত হয়েছে, তাদের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু এ বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ৬২(এফ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিচক্ষণ, ন্যায়পরায়ণ, মিতাচারী, সত্ ও সত্যবাদী না হলে কোনো ব্যক্তি পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হতে পারবেন না বা নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন পাবেন না।’
এখন অষ্টাদশ সংশোধনীর বিলে এই ধারায় কিছু নতুন কথা যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সে অনুযায়ী ‘পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার বা নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তি হবেন এমন ব্যক্তি, যাঁর বিরুদ্ধে কোনো আদালত এই মর্মে কোনো ঘোষণা দেননি যে তিনি বিচক্ষণ, ন্যায়পরায়ণ, মিতাচারী, সত্ ও সত্যবাদী নন।’ অষ্টাদশ সংশোধনীর বিলে সংবিধানের ৬২(জি) অনুচ্ছেদ পুরোপুরি বিলোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার বা নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্য হবেন না, যদি তিনি নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে বা মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার অপরাধে কোনো আদালত কর্তৃক দণ্ডিত হন।
এনআরও বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আরও বলা হয়েছে, এনআরওর মাধ্যমে সংবিধানের ৬৩(এইচ) ও ৬৩(আই) অনুচ্ছেদ অকার্যকর করে ফেলা হয়েছে। অষ্টাদশ সংশোধনীর বিলে ৬৩(এইচ) অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করা হয়েছে, কিন্তু ৬৩(আই) অনুচ্ছেদ স্পর্শ করা হয়নি। ৬৩(এইচ) অনুচ্ছেদের মূল ভাষ্যে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি পার্লামেন্টের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা হারাবেন, যদি তিনি দুর্নীতি, নৈতিক স্খলন বা ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে বিদ্যমান কোনো আইনের অধীনে যথাযথ এখতিয়ারসম্পন্ন কোনো আদালত কর্তৃক দণ্ডিত হন।’ অষ্টাদশ সংশোধনীর বিলে প্রস্তাবিত ৬৩(এইচ) অনুচ্ছেদের নতুন ভাষ্য অনুযায়ী এখন থেকে ‘একজন ব্যক্তি পার্লামেন্টের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা হারাবেন, যদি তিনি নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে কোনো আদালত কর্তৃক দুই বছর বা তার বেশি সময় কারাভোগ করেন; এবং কারাভোগের মেয়াদান্তে মুক্তির পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না পর্যন্ত তিনি পার্লামেন্টের সদস্য হতে পারবেন না।’ বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, এই অনুচ্ছেদ ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্ট জারদারির নির্বাচনে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে অযোগ্যতার প্রশ্নে বা ইমপিচমেন্ট ঠেকাতে সহায়ক হতে পারে।
সংবিধান সংস্কার কমিটির নির্ভরযোগ্য কিছু সূত্র দাবি করেছে, জামায়াতে ইসলামি ও জমিয়াতে উলামায়ে ইসলাম (ফজল) দলের সদস্যরা সংবিধানের ৬২ ও ৬৩ অনুচ্ছেদে বড় ধরনের পরিবর্তনের বিরোধী। কিন্তু পাকিস্তান পিপলস পার্টি, পাকিস্তান মুসলিম লিগ (এন), পাকিস্তান মুসলিম লিগ (কিউ), মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম) ও আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি (এএনপি) সংবিধানে সাবেক সামরিক স্বৈরশাসকদের ঢোকানো অনুচ্ছেদগুলো পরিবর্তনের পক্ষে। এএনপি চায় চার্টার অব ডেমোক্রেসির ৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী কেন্দ্রশাসিত উপজাতীয় অঞ্চলগুলো বা ফেডারেলি অ্যাডমিনিস্টার্ড ট্রাইবাল এরিয়াস (এফএটিএ) খায়বার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত হোক। কিন্তু উপজাতীয় অঞ্চলগুলোর প্রতিনিধিরা ওই প্রদেশের অংশ হতে চান না। তাঁরা চান পৃথক মর্যাদা। এখন পিপিপি ও পিএমএল (এন) দাবি করতে পারে যে তারা সংবিধান থেকে জেনারেল জিয়াউল হকের নাম মুছে ফেলেছে, কিন্তু তারা এটা দাবি করতে পারবে না যে চার্টার অব ডেমোক্রেসির মূল চেতনা তারা অনুসরণ করেছে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মশিউল আলম
হামিদ মীর: পাকিস্তানি সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.