ভিন্নমত-এখন কোনো কোনো শেয়ারের দাম কমেছে বটে তবে- by আবু আহমেদ

এখন বাংলাদেশের শেয়ারবাজার পুরোপুরি বিধ্বস্ত। এই শেয়ারবাজার সহসা প্রাণ ফিরে পাবে এমনও মনে হয় না। গত দুই সপ্তাহে চেনা পরিচিত অনেক লোকই একটা কথা জিজ্ঞেস করেছে, এ পতনের শেষ কোথায়? আমি তাদের সদুত্তর দিতে পারিনি। শুধু বলেছি, বিধ্বস্ত শেয়ারবাজারের তলানি বোঝা মুশকিল।


কারণ শেয়ারবাজারে ধস যদি এক দিনের হয় তাহলে পরের দিন উঠে দাঁড়ায়। ধস যদি এক সপ্তাহের হয় তাহলে পরের সপ্তাহে উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু ধস যদি সপ্তাহ পার হয়ে মাস গড়ায় তাহলে বুঝতে হবে ওই ধস থেকে বাজার উদ্ধার পেতে মুশকিল হবে। এ ধস কেন নামল? এক কথায় উত্তর হলো_এ বাজার থেকে প্রচুর অর্থ বাইরে চলে গেছে।
মোটা দাগে বলা চলে, শেয়ারবাজারের পিক সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে অর্ধেক অর্থ বাইরে চলে গেছে। ওই অর্থের সামান্য শতাংশ এখন বাজারে ফেরত আসে কি না বলা মুশকিল। তবে যারা টাকা সরিয়ে নিয়েছে তারা ভালো করেই জানে, বাজার আরো বিধ্বস্ত হলে তাদেরই লাভ। এ বিধ্বস্ত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলো কেমন করে? শুরু হয়েছে নভেম্বরের প্রথম থেকে, যখন মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো সুদ বেচার ব্যবসাটা জোরেশোরে চালিয়ে যাচ্ছিল। অন্যদিকে নিজেদের পোর্টফলিওগুলো খালি করছিল। লাখ লাখ বিনিয়োগকারী ওই প্রক্রিয়াটা বুঝতে অনেক সময় নিয়েছে। তারা যখন বুঝল তখন বাজার শুধু গর্জন করতে করতে নিচে নামছিল। ওই অবস্থায় বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী মনে করল, সরকার তাদের জন্য কিছু একটা করবে। কিন্তু বাজার পড়তে থাকলে কেউ যে কিছু করে না বা করতে পারে না তা বুঝতে তাদের আরো সময় লাগল। বাজার পুরোটা বিধ্বস্ত হয় কখন? যখন আস্থায় চিড় ধরে। আমাদের বাজারের বর্তমান অবস্থাও তাই। এত এত মিউচ্যুয়াল ফান্ডকে (Mutual Fund) ) যে এসইসি অনুমোদন দিল তারা কেন শেয়ার কিনছে না? কেন বারবার ঘোষণা সত্ত্বেও আইসিবি ও সরকারি ব্যাংকগুলো শেয়ার কিনে ধস ঠেকানোর প্রক্রিয়ায় এগিয়ে আসছে না? উত্তর হলো, সবাই আরো সুযোগের অপেক্ষায় আছে। তবে সেই সুযোগ আসবে বটে কিন্তু ততদিনে বাজার সম্পূর্ণভাবে বিনিয়োগকারী-শূন্য হবে, যেমন করে ঘটেছিল ১৯৯৭, ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে।
স্মরণ করুন, তখন বাজারে কতজন বিনিয়োগকারী আর অবশিষ্ট ছিল? হাতেগোনা কয়েক হাজার। আর ডিএসই ট্রেডিং ভলিউম নেমে এসেছিল ৫০ কোটি টাকার নিচে। এখন অবস্থাটা অত করুণ না-ও হতে পারে। তবে হতে পারে এর কাছাকাছি। এখন বাজারে সদাচরণে থাকবে বড়জোর কয়েক লাখ বিনিয়োগকারী। তবে সত্য এও হবে যে যারা থাকবে তারা প্রকৃত অর্থে বিনিয়োগকারী হবে। আমাদের শেয়ারবাজারটা আজকের এ বিধ্বস্ত অবস্থায় এল কেন? এল এ জন্যই যে বাজার যেভাবে চালানোর কথা ছিল সেভাবে চালানো হয়নি। যেদিন থেকে ব্যাংকগুলোর মুখ্য কাজ হলো শেয়ারবাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে এক টাকার বিপরীতে দুই টাকা ঋণ বিক্রি করা, সেদিনই বুঝতে সক্ষম হয়েছিলাম সামনে শেয়ারবাজারের দুর্দিন আসছে। যেদিন থেকে মিউচুয়াল ফান্ড তার নিট সম্পদ বা ঘঅঠ-এর পাঁচ গুণে বেচাকেনা হচ্ছিল, তখনই বুঝতে পারছিলাম শেয়ারবাজারে দুর্দিন আসছে। যেদিন থেকে দেখলাম 'জেড' গ্রুপের কম্পানি টপ দশ ট্রেডিং কম্পানির মধ্যে আসছে, সেদিনই বোঝা গিয়েছিল শেয়ারবাজারের দুর্দিন আসবেই।
কিন্তু এসব দিকে পলিসি মেকারদের কম নজর ছিল। তারা ব্যস্ত ছিল শেয়ারবাজারকে প্রসার করা এবং সেই সঙ্গে ক্রেডিট নেওয়ার কাজে। আর এখন কী ফল দাঁড়াল? উঁচু দরের আইপিও কে কিনবে? যে শেয়ারবাজারে আছে সে শেয়ারের উচিত মূল্য হজম করার ক্রেতাও বাজারে নেই। যাঁরা বলছেন শেয়ারবাজারের সঙ্গে প্রকৃত অর্থনীতির কোনো সম্পর্ক নেই, তাঁরা মস্তবড় একটা ভুল মন্তব্য করছেন। শেয়ারবাজার মৃত থাকলে অর্থনীতিও অনেকটা তাই থাকে। অর্থনীতিতে আশাবাদ সৃষ্টিই হয় শেয়ারবাজারকে ঘিরে। একবার ভাবুন, সেই আশাবাদে চিড় ধরেছে, তাহলে অর্থনীতি কি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না?
যেসব আইপিও পাইপলাইনে ছিল সেগুলো বাজারে আসতে পারলে আমাদের আরো ফাইভ স্টার হোটেল, বোয়িং উড়োজাহাজ, অনেক স্পিনিং মিলস হতো। আর এখন ওই বাজার বন্ধ হওয়ার ফলে সহজে পুঁজি তোলার ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? সে জন্যই বারবার বলছিলাম, ওই বাজারকে ঘিরে লোভের ফাঁদ পাতা ঠিক হয়নি। তাতে রাজহাঁসটা মরে গেল, আর স্বর্ণডিম্ব লাভের আশাটাও অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। আজকে কোনো কোনো শেয়ার সস্তা মনে হবে। আমরা যেসব ফর্মুলা ব্যবহার করে শেয়ারের উচিত মূল্য বের করি, ওই সবের নিরিখে কোনো কোনো শেয়ার সস্তাই বটে। তবে পতনশীল বাজারে কোনো সস্তাই শেষ সস্তা নয়। অন্যদিকে এ বিধ্বস্ত বাজারেও অনেক শেয়ারের এখনো উচ্চমূল্য। ওই সব শেয়ার থেকে বিনিয়োগকারীদের সাবধান থাকতে হবে বৈকি।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অর্থনীতিবিদ

No comments

Powered by Blogger.