অর্থনীতি-৪০ বছরে আমাদের পথচলা by মামুন রশীদ

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ৪০ বছর ধরে ভূমিকা রেখে চলেছেন কিংবা সম্পৃক্ততা রয়েছে, এমন কয়েকজনের সঙ্গে গেল কিছুদিন অনেক আলোচনা হয়েছে আমার। তাঁদের অধিকাংশেরই আবার আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে এবং বিভিন্ন সময়ে অর্থনৈতিক উত্তরণের পর্যায় ও সংকট ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ অবদান রয়েছে।


আলোচনাকালে তাঁদের অনেকেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অন্তর্মুখী রেমিট্যান্স বা প্রবাসী-আয়ের প্রবাহ, কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে অর্থনৈতিক উদারীকরণের পদক্ষেপ নেওয়া, পোশাকশিল্পে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনকে কৃতিত্ব দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ উন্নয়নের নেপথ্য অনুঘটক ও অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি, আমাদের সমাজে অর্থনৈতিক কাঠামোয় পরিবর্তনের প্রবণতা, উন্নয়ন-অংশীদার তথা দাতা সংস্থাগুলোর ভূমিকা, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, বিশেষ করে নারীশিক্ষার প্রসার, প্রচুরসংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিকের বিদেশ গমন ও অভিবাসন প্রভৃতির অবদানের কথা তুলে ধরেছেন। দু-একজন অবশ্য ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ থেকে শিক্ষা নেওয়া, যোগাযোগব্যবস্থায় অগ্রগতি, বিশেষ করে মুঠোফোনের ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া প্রভৃতি দেশের উন্নয়নে সম্যক অবদান রেখেছে বলে উল্লেখ করেন।
আমরা জানি, সত্তর দশকের একেবারে গোড়ার দিকে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে অধিকাংশ উন্নত দেশ ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা বাংলাদেশ নামের সদ্য স্বাধীন জনপদে সাহায্য নিয়ে আসার ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহ দেখায়নি। যা হোক, বিভিন্ন সময়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় এবং অব্যাহত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যেও বাংলাদেশ প্রত্যাশা ও সম্ভাবনা অনুযায়ী না পারলেও মোটামুটি সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। তবে সেই অগ্রগতির অভিযাত্রার মধ্যেও দেশের অন্যতম মৌলিক উৎপাদনশীল খাত কৃষি শিল্পায়নের ছায়ায় অনেকটা যেন ঢাকা পড়ে যায়। বিনিয়োগকারীরা এদিকে বলতে গেলে মনোযোগ দেনইনি। ১৯৭৪ সালে ১০ মাস স্থায়ী দুর্ভিক্ষের কারণে তখন দেশের কৃষি খাতের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। স্বাভাবিকভাবে তখন খাদ্যনিরাপত্তাই ছিল সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয়। তবে প্রায় এক দশক পরে অবশেষে যখন দেশে খাদ্য উৎপাদনে ব্যাপকভাবে গতিশীলতা দেখা দেয়, তখন ‘খাদ্যাকাশ’ থেকে অনিশ্চয়তার কালো মেঘও সরে যেতে শুরু করে, বিশেষ করে উচ্চফলনশীল (উফশী) আধুনিক জাতের ধানের চাষাবাদ বাড়ার সুবাদে খাদ্য উৎপাদন ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) মোট ৫৭টি উফশী ধানের জাত উদ্ভাবন করে। এর মধ্যে ৫৪টি ইনব্রেড বা প্রকৃতিজাত ও চারটি হাইব্রিড বা বর্ণসংকর জাতের ধান। গত শতকের ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে এই জাতের ধানের উদ্ভাবন ও চাষাবাদের প্রচলন বাড়ে। এসব জাতের ধানের আবার রোগবালাই ও কীটপতঙ্গের আক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষমতা বেশি হওয়ায় এগুলোর চাষাবাদ ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
এরই মধ্যে অবশ্য দেশে ধীরে ধীরে তৈরি পোশাকশিল্পের (আরএমজি) বিকাশ ঘটতে শুরু করে, যা একসময় দেশে সামগ্রিক শিল্পায়ন-প্রক্রিয়ায় গতিশীলতা আনে এবং মোট দেশজ উৎপাদনেও (জিডিপি) উল্লেখযোগ্য হারে অবদান রাখতে শুরু করে। আশির দশকের শেষ দিকে যেখানে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল ২০ শতাংশের মতো, ২০১০ সালে এসে তা বেড়ে ৩০ শতাংশে উন্নীত হয়। অন্যদিকে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান কমে ২০ শতাংশের নিচে নেমে যায়। তবে আগেই যা বলেছি, কৃষিতে উন্নতজাতের চাষাবাদ প্রবর্তনের ফলে উৎপাদনশীলতা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। সত্তরের দশকের শুরুতে যেখানে এক কোটি ১০ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়, ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় তিন কোটি ৪০ লাখ টনে। জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে সেবা খাতের প্রবৃদ্ধির কারণে; যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মুঠোফোন ও আর্থিক খাত।
শিক্ষার সুযোগ বাড়ায় দেশে জেন্ডার ব্যালেন্স বা নারী-পুরুষের মধ্যে ভারসাম্য জোরদার হয় এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এর প্রতিফলন ঘটে। এর ফলে দেশে ক্রমান্বয়ে দারিদ্র্য কমে এবং স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটে। স্বাধীনতার পরপর যেখানে জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত, ২০০৯ সালের শেষ দিকে তা ৩৮ শতাংশে নেমে আসে। দারিদ্র্য হ্রাসের এই প্রক্রিয়া প্রায় সব জায়গায়ই প্রতিভাত, যা অনেকাংশে নতুন এক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবিই যেন ফুটিয়ে তোলে।
এই লেখার শুরুর দিকে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গ তুলেছিলাম। সেই সময়ে গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যে আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে বিদেশ গমন, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার প্রবণতা শুরু হয়। বর্তমানে ৮০ লাখের বেশি বাংলাদেশি বিদেশে কাজ করছেন। যাঁরা কষ্টার্জিত রেমিট্যান্স বা প্রবাসী-আয় পাঠানোর মাধ্যমে শুধু গ্রামীণ অর্থনীতিতেই নয়, বরং বৃহত্তর জাতীয় অর্থনীতিতেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছেন।
আশার কথা হলো, বর্তমানে দেশের প্রায় সর্বক্ষেত্রেই ইতিবাচক পরিবর্তনের সুবাতাস বইছে। সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক পর্যন্ত সবার দৃষ্টিভঙ্গিই যেন এখন পরিবর্তনের দিকে নিবদ্ধ। দেশের নারীসমাজও এখন আর শুধু রান্নাবান্না নিয়ে হেঁশেলের চৌহদ্দিতে আটকে নেই। তাঁরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন, এগিয়ে যাচ্ছেন সামনের দিকে। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে নারীরা বিপুল সংখ্যায় দেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে থাকেন। বদৌলতে দেশের ৬০-৭০ শতাংশ নারী জিডিপিতে অবদান রাখছেন।
আশির দশক থেকে ২০১০ সালের মধ্যে দেশে ব্যাপক হারে নতুন নতুন উদ্যোক্তার আবির্ভাব ঘটেছে। এই সময়ে বিশেষ করে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) বিকাশটা ছিল লক্ষণীয়। কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে না হলেও আর্থিক খাতে ক্রমাগত গভীরতা সৃষ্টি এ ক্ষেত্রে ব্যাপক সহায়তা করেছে। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলে উদ্যোক্তা তৈরিতে, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তা বিকাশে বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ও ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও (এমএফআই) উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।
বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন-প্রক্রিয়া ও ধারণায় পরিবর্তন এবং উন্নয়ন সংস্থাগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের উন্নয়ন এজেন্ডা নতুনভাবে তৈরি করতে সাহায্য করেছে। পাশাপাশি উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে বেসরকারি খাতের গুরুত্বও অব্যাহতভাবে বাড়ছে। এ ধরনের উত্তরণ-প্রক্রিয়া ত্বরান্বিতকরণ সন্দেহাতীতভাবেই কঠিন কাজ, যা করতে পারাটা আমাদের জন্য কৃতিত্বের বটে। তবে এ ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ গণমাধ্যমেরও বড় ভূমিকা রয়েছে। কারণ গণমাধ্যম মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন, সংকট মোকাবিলা ও গণতন্ত্রের উত্তরণের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে চলেছে, বিশেষ করে এখানে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার গত এক দশকের ভূমিকা উল্লেখ করা যায়। গত ১০-১৫ বছরে সংকটজনক পরিস্থিতির ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের সক্ষমতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে (এ ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় দাতা সংস্থাগুলোরও কিছু কৃতিত্ব আছে)। কর খাতের অব্যাহত সংস্কার কর আদায়ের পরিমাণ বিপুল পরিমাণে বাড়িয়েছে। আমদানি-রপ্তানি দুই-ই বেড়েছে। রপ্তানি খাতে যেখানে তৈরি পোশাকের অবদান অনেক বেশি, তেমনি আমদানি খাতেও মূলধনি যন্ত্রপাতির আধিক্য রয়েছে।
যা হোক, ১৬ কোটি মানুষের অন্নের সংস্থান নিশ্চিত করতে বাংলাদেশকে দ্রুতগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলতে হবে। প্রতিবছর দেশে যেহেতু জনসংখ্যা ১ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বাড়ছে এবং আবাসনের চাহিদা মেটানো ও শিল্পায়নের কারণে ১ শতাংশ করে কৃষিজমি কমে যাচ্ছে, সেহেতু নতুন উদ্যমে, পরিকল্পনায় কাজ করতে হবে; যাতে নিকট কিংবা দূর ভবিষ্যতে খাদ্য নিয়ে কোনো রকম সংকটে পড়তে না হয়। জিডিপিতে বছরে ৭ থেকে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে ম্যানুফেকচারিং বা উৎপাদন খাতে বিপুল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করা অপরিহার্য। এ জন্য গ্যাস-বিদ্যুৎ, সড়ক, রেলওয়ে, সেতুসহ সার্বিক অবকাঠামো খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হবে। সেই সঙ্গে কৃষি, শিল্প ও ম্যানুফেকচারিং বা উৎপাদন খাতের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা বা কর্মপরিকল্পনা থাকা জরুরি। আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণসহ স্থানীয় সরকার, জনপ্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা শক্তিশালীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ থাকতে হবে। দেশকে প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে সার্বিকভাবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন এবং অবকাঠামো খাতে আন্তর্জাতিক অর্থায়নের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া রাষ্ট্র তথা সরকার পরিচালনার নীতিমালা অব্যাহত রাখতে এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে সুশাসন ও রাজনৈতিক সহনশীলতার বিকল্প নেই।
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে একদা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উপহাস করা হলেও এখন আর সেটির কোনো ভিত্তি নেই, তা আমরা জোর দিয়েই বলতে পারি। সার্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অগ্রগতি, সামাজিক পরিবর্তন, প্রায় স্বাধীন গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ, কর্মক্ষেত্রে নারীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকার সুবাদে বাংলাদেশ অনেকটাই ‘ডেভেলপমেন্ট প্যারাডক্স’ বা ‘উন্নয়নের প্রতিকল্প’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আর হিতাকাঙ্ক্ষীরা আমাদের অগ্রগতি অর্জনের এই অভিযাত্রা প্রত্যক্ষ করছে। আসুন, আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে দেশকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে একযোগে কাজ করি, আর স্বপ্নের সেই দেশ গড়ে তুলি, যার জন্য ৪০ বছর ধরে আমরা অপেক্ষায় আছি।
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।

No comments

Powered by Blogger.