ছাত্রী উত্ত্যক্ত ও নির্যাতন-আর চুপ করে থাকা যায় না by ফরিদা আখতার

বেশ কিছুদিন ধরে নারী নির্যাতনের একটি নতুন প্রবণতা দেখছি। এবং এর ভয়াবহতা দেখে যেমন উদ্বিগ্ন হচ্ছি, তেমনি অবাক হচ্ছি নির্যাতনকারীদের প্রতি প্রশাসনের সদয় ব্যবহার দেখে। এ ধরণের যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার বিচার হতে দেখিনি। কোনো উত্ত্যক্তকারী বখাটে ছেলে শাস্তি পায়নি।


স্কুলগামী মেয়েদের উত্ত্যক্ত করছে পাড়ার বখাটে ছেলেরা, এই খবর এখন প্রায় শোনা যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে ভুক্তভোগী মেয়েরা। একটি নয়, দুটি নয়, গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি ঘটনা ধারাবাহিকভাবেই ঘটে গেছে। প্রতিবাদ যা একটু হয়েছে তাতে কোনো কাজ হয়নি। আজ পর্যন্ত এক বখাটে ছেলেকেও পুলিশ ধরতে পারেনি, কিংবা ধরেনি। মেয়েগুলোর কচি প্রাণ ঝরে পড়েছে অকালেই। যারা মরেনি, তারা গুমরে মরছে নিজেদের মধ্যেই।
২৪ মার্চ যে ঘটনাটি ঢাকায় ঘটেছে তা কল্পনার অতীত, নির্মম। মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় দিনের আলোতে প্রকাশ্যে ঘরে এসে কমান্ডো স্টাইলে গুলি করে মা ও বাবাকে মেয়ের সামনে হত্যা করে ঘাতক রুবেল ও মিথুন গেট দিয়ে বের হয়ে চলে গেছে কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারেনি। পরে ঝালকাঠি থেকে পুলিশ এই দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়েছে সারা দেশে। এই দিনটি সবাই মন খুলে আনন্দের সঙ্গে পালন করেছে। কিন্তু সেদিনের পত্রিকায় প্রথম পাতায় শিরোনাম মুক্তিযুদ্ধের ঘটনার চেয়েও বড় হয়ে এসেছে সেই ঘাতক রুবেল ও তার সহযোগী মিথুনের ছবি ও তাদের বুক ফুলিয়ে কথা বলার কথা। টেলিভিশনে মুক্তিযুদ্ধের নাটক যা দেখেছি, তাতে একাত্তরের যেসব ঘাতক নারী নির্যাতন করে অট্টহাসি হেসেছিল, এই চেহারা যেন তাদেরই। আমরা কি এখনো স্বাধীন হইনি? এ দেশের মেয়েরা কি নির্যাতিত হতেই থাকবে? মা-বাবাকে মেয়ের সামনে গুলি করে হত্যা করে হত্যাকারী রুবেল চিত্কার করে বলেছে ‘তোর বাপ-মায়েরে মাইরা ফেললাম। এবার একলা একলা থাক’ (প্রথম আলো ২৫ মার্চ, ২০১০)। শুধু তাই নয়, ইতি ও বীথির বড় ভাই শিহাবের মোবাইলে ফোন করে বাড়াবাড়ি না করার জন্য হুমকি দিয়েছে ঘাতকেরা (যুগান্তর ২৬ মার্চ, ২০১০)। স্বাধীনতা দিবসে পত্রিকা পড়তে গিয়ে এইসব খবর পড়তে হয়েছে আমাদের। এই লজ্জা আমরা কোথায় রাখব? এই স্বাধীন দেশে আমরা এই কচি বয়সের মেয়েদের স্বাধীনভাবে লেখাপড়া করার অধিকারটুকুও দিতে পারছি না?
বখাটেদের তাণ্ডব শুধু এখানেই নয়। সব জায়গায় হচ্ছে। কুমিল্লায় অতিথি পাখি শিকার ও স্কুলের ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় পপি নামের একটি কিশোরী মেয়েকে এয়ার গান দিয়ে গুলি করে তার চোখ নষ্ট করে দিয়েছে বখাটে ছেলেরা। ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী পপি পাখি শিকার করা এবং ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল। পপির একটি চোখ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। যায়যায়দিন এবং যুগান্তর পত্রিকায় (২৬ মার্চ) প্রথম পাতায় পপির চোখে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় ছবিসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে।
ঢাকার জোড়া খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত খুনিদের সঙ্গে সরকারি দলের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সম্পর্ক রয়েছে বলে জানা গেছে। তাই কি কিছু করা যাচ্ছে না? তাই কি তারা হুমকি দিয়ে বেড়াতে পারছে? স্বাধীনতা দিবসের কর্মসূচিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যতই ব্যস্ত থাকুন না কেন, তিনি যদি একবার সেই বাড়িতে যেতেন এবং অসহায় পরিবারটিকে আশ্বাস দিতেন, তাদের পাশে থাকার কথা বলতেন তাহলে স্বাধীনতা দিবসের সার্থকতা হতো। কিন্তু সেটা হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একজন নারী, বিষয়টি তাঁর মনে দাগ কেটেছে কিনা বুঝতে পারছি না। শুধু তাই নয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ও বাদী হয়ে মামলা করতে পারে। নারী ও শিশুবিষয়ক সংসদীয় কমিটি এই ব্যাপারে চুপ করে আছে কেন? বাল্যবিবাহ বাড়ছে বলে এবার আন্তর্জাতিক নারী দিবসে অনেক কথা বলা হয়েছে। কিন্তু স্কুলে পাঠাতে গিয়ে ছেলেদের উত্ত্যক্ত করা ঘটনা ঘটলেই মা-বাবা সহজ পথ হিসেবে মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেন। অন্তত বিয়ের আগে কোনো কেলেংকারির ঘটনা না ঘটুক, তাহলে তো মেয়েটির আজীবন বিয়ে হবে না। কিংবা শুধু এই কারণেই তাকে বেশি যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিতে হবে। আমরা এমন মা-বাবাকে ‘অসচেতন’ মনে করি। কিন্তু যেখানে রাষ্ট্র তাঁদের মেয়েদের জীবনের এবং সম্মান রক্ষার দায়িত্ব নেয় না সেখানে তাঁদের কাছে আর তো কোনো পথ খোলা নেই। মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে দেশব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে কেবিনেট ও জাতীয় সংসদে অধিকসংখ্যক নারীর কথা বলে গর্ব করেছি, কিন্তু তাঁরা আজ কোথায়? এ দেশের মেয়েদের রক্ষা করার জন্য তাঁরা এগিয়ে আসছেন না কেন? তাঁদের কি কোনোই দায়িত্ব নেই? সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্যরা তাঁদের কোনো কাজ দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ করেন। কই এই ব্যাপারে তাঁরা এগিয়ে আসছেন না কেন? এরই মধ্যে জাতীয় সংসদ চলাকালীন অনেক ঘটনাই ঘটেছে। তাঁরা কোনো কথা বলেননি। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা ছাড়া কাউকেই এই বিষয়ে কথা বলতে শুনিনি। তাহলে কি নারী নির্যাতনের ঘটনা শুধু বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সরকারের ব্যর্থতা প্রমাণের বিষয় হয়ে থাকবে? বিরোধী দল এই ধরনের কথা বললেই সরকারের পক্ষ থেকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ করা হয়। বলা হয় প্রমাণ করে দেখান। আর বিরোধী দলও তারপর আর কিছু বলে না। এই পাল্টাপাল্টিতে নারী নির্যাতন খেলার মতো উপভোগ করার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
এভাবে চলতে থাকলে বহু স্কুলগামী মেয়ে তাদের শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে যাবে। সমকাল-এর শিরোনাম (২৬ মার্চ) ‘পড়ালেখা বন্ধ করেও মা-বাবাকে বাঁচাতে পারেনি ইতি’। অর্থাৎ ইতির মা-বাবা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটার কারণেই আমরা জানতে পেরেছি যে নিলুফার ইয়াসমিন ইতি এই ছেলেরা বিরক্ত করত বলে একা বাইরে যেতে পারত না। তাই তার স্কুলে যাওয়া প্রায় বন্ধই ছিল। এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারেনি। শিক্ষামন্ত্রী কি জানেন, এসএসসি পরীক্ষা অনেক মেয়েই হয়তো শুধু উত্ত্যক্ত করার কারণে দিতে পারছে না। বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্ব হওয়া কি উচিত নয়? একটি বড় ধরনের ঘটনা, যেমন আত্মহত্যা কিংবা হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পরই সবাই কথা বলছি। কিন্তু সব জায়গায় খোঁজ নিয়ে দেখুন মেয়েদের স্কুলে পড়াশোনা এখন খুবই কষ্টের হয়ে গেছে। একা স্কুলে যাওয়া-আসা করা সম্ভব হচ্ছে না অনেক মেয়েরই। দিনের পর দিন উত্ত্যক্ত করার কারণে মেয়েরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত এদেরই কেউ কেউ নিজের জীবন নিজেই কেড়ে নিয়ে আমাদের সবাইকে জানান দিয়ে যাচ্ছে পরিস্থিতি কত খারাপ। আর সরকার এই ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে যেন কিছুই হচ্ছে না। পত্রিকা পড়ে লজ্জা পেয়েছি যে প্রভাবশালী মহলের ছাত্রীরা, যেমন ছাত্রলীগের মেয়েরা সরাসরি নারী নির্যাতনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। ইডেন গার্লস কলেজের লজ্জাজনক ঘটনার পর সাধারণ ছাত্রীর নিজেদের মান বাঁচাতে কলেজ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এটাও কি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেখার বিষয় ছিল না? যে কলেজে এমন ঘটনা ঘটে সেখানে অভিযুক্ত ছাত্রীদের বহিষ্কার করা হলো না কেন? কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেই বা কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না কেন?
অর্থাৎ বর্তমানে প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকলে পুরুষ ও নারী উভয়েই নির্যাতনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। আর কোনো প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না বলে ঘটনাগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। মেয়েরা নিজের জীবন দিচ্ছে, কিংবা তাদের মা-বাবাকে হত্যা করা হচ্ছে, আত্মীয়স্বজনকে নিয়মিতভাবে হুমকির মধ্যে থাকতে হয়। লোকলজ্জা তো আছেই। কারণ সমাজও এমনই যে মেয়েদের নিয়ে কোনো ঘটনা ঘটলে সেটা যেন কোনো না কোনোভাবে মেয়েদেরই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কই রুবেল-মিথুনের পরিবারকে তো কেউ ধিক্কার দিচ্ছে না। সংবাদ মাধ্যম তাদের পরিবারকে তুলে ধরছে না।
এখন একমাত্র ভরসা নারী আন্দোলন বেগবান করা। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং এই অল্প বয়সী মেয়েদের শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের সব পর্যায় থেকে সক্রিয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ক্রমাগত আন্দোলন করতে হবে।
ফরিদা আখতার: নারী আন্দোলনের নেত্রী।

No comments

Powered by Blogger.