কারমাইকেল কলেজ-মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণ শেষ হবে কবে by শান্ত নূরুননবী

রংপুরের কারমাইকেল কলেজ বাংলাদেশে বিখ্যাত ও ঐতিহ্যমণ্ডিত। আব্দুর রহমান, শাহ সোলায়মান আলী, কালাচাঁদ রায়, চিত্তরঞ্জন রায়, সুনীল বরণ চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ অধিকারী, মুখতার এলাহীসহ এই কলেজের অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী ১৯৭১ সালে এ দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দেন।


অথচ এই বিশাল কলেজ ক্যাম্পাসে আজও মুক্তিযুদ্ধের কোনো দৃশ্যমান স্মারক নেই।
শব্দকণ্ঠ কারমাইকেল কলেজের সাংস্কৃতিক সংগঠন—তারুণ্যে ভরপুর এর সদস্যরা আশি ও নব্বইয়ের দশকে নিছক কবিতা লিখে ও আবৃত্তি চর্চা করে তুষ্ট হতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতির চেতনা বিকাশে নানামুখী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শুধু কারমাইকেল কলেজে নয়, পুরো রংপুর শহরেই সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। স্বাধীনতার ৩০ বছর পর দীর্ঘ সামরিক শাসন শেষে ১৯৯১ সালে শব্দকণ্ঠ কারমাইকেল কলেজে মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মারক ভাস্কর্য নির্মাণের পরিকল্পনা করে।
ভাস্কর্যের একটি নকশা তৈরি করেন ভাস্কর অনিক রেজা। কলেজের নজরকাড়া স্থাপত্যশৈলীর শতবর্ষী মূল ভবনের সঙ্গে সংগতি রেখেই নকশা করা হয়েছিল। মঞ্চ হিসেবে ব্যবহারের উপযোগী নকশা করা হয়েছে পাঁচ ফুট উঁচু বেদির। পেছন দিকে সরু ও সামনের দিকে ধাপে ধাপে বেদির ওপরের দিকে উঠে যাবে প্রশস্ত সিঁড়ি। বেদির শরীরজুড়ে জড়িয়ে থাকবে বীর শহীদদের মুখাবয়বের ম্যুরাল। বেদির সম্মুখ ভাগে প্রশস্ত মঞ্চ রেখে পেছনে স্থাপিত হবে ১০ ফুট উচ্চতার মুক্তিযোদ্ধার আদল। মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যয়ী ডান হাতের বজ্রমুষ্ঠিতে ধরা রাইফেল। বাঁ হাত বাবার স্নেহে জড়িয়ে রাখবে কাঁধে বসে থাকা শিশুর পা। মুক্তিযোদ্ধার কাঁধে বসে থাকা শিশু ডান হাতে উঁচু করে রাখবে লাল-সবুজ পতাকা। বাবার মাথায় বাঁ হাত। নতুন প্রজন্মের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধা বাবার পতাকার মান রাখার প্রতিশ্রুতি এভাবেই প্রকাশিত ভাস্কর্যে। ভাস্কর্যের নাম তাই প্রজন্ম। রড-সিমেন্ট-পাথরে ভাস্কর্য নির্মাণ করা হবে ৪০০ বছরের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে।
একটি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চত্বরে ভাস্কর্য নির্মাণের অনুমতি নিতে শব্দকণ্ঠকে পার হতে হয়েছে নানা দপ্তরের লালফিতার জাল। তখনকার অধ্যক্ষ রেজাউল হক অবশ্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক সহায়তা করেছেন। তারপর শুরু হয় কুপন ছাপিয়ে ১০ টাকা, ২০ টাকা, ৫০ টাকা করে অর্থ সংগ্রহের কাজ। কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও রংপুরের আপামর জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততায় অল্প সময়েই জোগাড় হয়ে যায় দুই লাখ টাকা। যা জমা হয়েছিল ন্যাশনাল ব্যাংকের রংপুর শাখার অ্যাকাউন্টে। এটি ছিল রেজাউল হক ও অধ্যাপক মোজাহার আলীর যৌথ নামে। টাকা সংগ্রহের কাজ চলমান রেখে ১৯৯২ সালে স্থাপিত হয় প্রজন্মের ভিত্তিপ্রস্তর। ভাষাসৈনিক আ ন ম গাজীউল হক রংপুরে এসে উন্মোচন করেন এই ভিত্তিপ্রস্তর। বেদির নির্মাণকাজে কেবল শব্দকণ্ঠই নয়, অংশ নিল কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সব প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিরা। মনে করতে এখনো ভালো লাগে, আমরা সবাই সারবেঁধে একজনের হাত থেকে আরেকজন ইট নিয়ে সরবরাহ করেছিলাম নির্মাণকর্মীদের হাত পর্যন্ত।
স্বাধীনতাবিরোধী চেতনার ধারক ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীরা কারমাইকেল কলেজে ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করে শুরু থেকেই। বেদি নির্মাণের প্রাথমিক কাজ যখন সমাপ্তির পথে, ১৯৯২ সালের ২৯ মার্চ জামায়াতে ইসলামীর পোষ্য সংগঠন ছাত্রশিবিরের গুন্ডাবাহিনী কলেজে প্রবেশের মুখে ধারালো অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে শব্দকণ্ঠের কর্মীদের ওপর। লোহার রড দিয়ে পায়ের হাড় থেঁতলে দেওয়া হলো অবিনাশ রেজার (বর্তমানে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক); বোমার আঘাতে ছিন্ন হয়ে গেল মোজেদুর রহমান সুষমের বাঁ পায়ের লিগামেন্ট; দুই পায়ের হাড় ভেঙে দেওয়া হলো এবং মাথা ফাটিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হলো জুয়েল মমতাজকে (ছয় মাস চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত)। তার আগেই শব্দকণ্ঠের কাজে সহযোগিতা করার অপরাধে শিবিরের গুন্ডাদের প্রহারে গুরুতর আহত হলেন ছাত্রলীগের তত্কালীন নেতা রফিক সরকার (বর্তমানে ডেইলি স্টার-এর রংপুর প্রতিনিধি)। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো ভাস্কর্যের বেদি। পরের দিন ৩০ মার্চ ১৯৯২ বিকেলে ভাস্কর্য নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য ভাস্কর্যের অর্ধনির্মিত বেদির পাশেই পিটিয়ে আধমরা করা হলো ছাত্রলীগের (জাসদ) নেতা প্রদীপকে। পুরো শহর স্তব্ধ হয়ে গেল এই ন্যক্কারজনক ঘটনায়, কিন্তু কিছুই করল না বা করতে পারল না পুলিশ কিংবা প্রশাসন; কারণ তত দিনে ‘ধর্মের নামে বজ্জাতি’ করে বেড়ানো এই দলটি অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
কিছু দিনের মধ্যে ভাস্কর্য বাস্তবায়ন কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করে অপশক্তির বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার উদ্যোগ নিল রংপুরের মানুষ। কমিটিতে যুক্ত হলেন রংপুরের ১৭টি রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা। কমিটির তত্ত্বাবধানে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৯ সময়কালে ভাস্কর্যের বেদিমূল সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিল। তারপর ১৯৯৯ সালের ২৬ জুলাই অস্ত্রবাজি করে পুরো কারমাইকেল কলেজ দখল করল ছাত্রশিবির। সেখানে ছাত্রদল, ছাত্রলীগসহ সব দলেরই কার্যক্রম থেমে গেল শিবিরের দাপটের তোড়ে এবং আবারও ভেঙে ফেলা হলো প্রজন্মের বেদি।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, কেবল ছাত্রশিবিরের প্রতাপের কারণে কারমাইকেল কলেজে, প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থীর এই শিক্ষাঙ্গনে, একটি মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণ করা যাচ্ছে না। মাসুদ করিম নামের একজন সংস্কৃতিকর্মী দুঃখ করে বলেন, ‘যে দেশে মৌলবাদীদের ভয়ে বিমান বন্দরের সামনে লালনের ভাস্কর্য নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়, ঢাকার বলাকা ভাঙচুরকারীদের সাজা হয় না, সেখানে রংপুরে প্রজন্ম ভাস্কর্য নির্মাণ করা সত্যিই কঠিন কাজ।’
মাসুদকে প্রশ্ন করি, কতটা কঠিন? তীর-ধনুক নিয়ে ১৯৭১ সালে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করার চেয়ে কি কঠিন?
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতাসীন। রংপুরবাসী আশা করে, বাংলাদেশের সপ্তম বিভাগীয় শহর রংপুরের স্বনামধন্য কারমাইকেল কলেজে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য প্রজন্ম নির্মাণে সরকার ও প্রশাসন এখনি উদ্যোগী হবে।
শান্ত নূরুননবী: লেখক ও উন্নয়নকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.