গন্তব্য ঢাকা-কবে ফিরব ঘরে by সিদরাতুল সিনড্রেলা

১৯৯০ সাল। বয়স তখন ১৩-১৪ বছর। একজন লোক মা-বাবাকে গিয়ে বললেন, ‘কিছু টাকা দিন, আপনার ছেলেকে নিয়ে যাই। বিদেশ যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিব। পাসপোর্ট, ভিসা ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পর করে দিব।’ বাবা-মা তো খুব খুশি।


ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আর নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা চিন্তা করে অনেক কষ্টে ৬০ হাজার টাকা তুলে দিলেন ওই লোকটির হাতে। কিশোর ছেলেকে নিয়ে লোকটি এলেন ঢাকায়। তারপর ছেলেটিকে ফেলে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। না, আর দেখা পায়নি ছেলেটি তাঁর। কিশোর ছেলেটি কেন যেন অভিমান করে বসল মা-বাবার ওপর। কেন তাঁরা তাকে ওই লোকের সঙ্গে একা পাঠিয়ে দিলেন ঢাকায়। রাগ করে আর গেলই না বাসায়। সেই শুরু তার কষ্টের সঙ্গে সংগ্রাম করে একা একা ঢাকায় থাকা। ছেলেটির নাম মো. জাকির হোসেন। বরিশালের বাকেরগঞ্জে তার বাড়ি। দাড়িয়াল ইউনিয়নের কাজলাকাঠি গ্রাম।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে মূল ফটকের কাছে সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মাঠা বিক্রি করেন জাকির হোসেন। রোদে পুড়ে সাদা মুখখানি রক্তিম হয়ে উঠেছে তাঁর। মাথায় একখানি সাদা টুপি। দুই হাতে দুটি গ্লাস নিয়ে একটি থেকে অন্যটিতে মাঠা ঢেলে মেশানোর কাজ করে চলেছেন তিনি। অফুন্ত সময় নেই জাকিরের। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথা চলে তাঁর সঙ্গে। মা-বাবা, স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে থাকেন গ্রামে। তাঁদের ছেড়ে কি ঢাকায় একা একা থাকতে মন টেকে? কিন্তু কি আর করার আছে? জীবিকার তাগিদে যে থাকতেই হবে।
নদীভাঙনে যদি সব কিছু না হারাত, তবে হয়তো গ্রামে গিয়ে হালচাষ করে বা অন্য কিছু করে স্ত্রী-সস্তান নিয়ে সুখেই থাকতেন তিনি। কিন্তু সেটা তো আর হলো না। থাকতে হয় ঢাকায়। প্রথম যখন ঢাকায় এসেছেন, তখন কিছু জানেন না, কিছুই চেনেন না। এদিক-ওদিক ঘুরতেন। শুরু করলেন পুরোনো জামাকাপড় বিক্রির কাজ। দীর্ঘদিন ওই কাজ করার পর শুরু করলেন নতুন ব্যবসা। মাঠা, দই আর বরফ মিশিয়ে তৈরি পানীয় বিক্রি শুরু করলেন। প্রচণ্ড দাবদাহে যখন তৃষ্ণায় গলা ফেটে চৌচির, তখন পরিশ্রান্ত পথচারীদের ‘এই ঠান্ডা খান, ঠান্ডা হন’ বলে আকৃষ্ট করেন তিনি। পথচারীরা তাঁর সেই ঠান্ডা পানীয় খেয়ে ঠান্ডা হয়ে পুনরায় কাজে মন দেন। ৪০০-৫০০ টাকা নিয়ে প্রথম শুরু করেছিলেন এ ব্যবসা। তখন লাভও হতো সে অনুপাতেই। বর্তমানে এক হাজার টাকা চালান। প্রতিদিন যতটুকু আনেন, তার সবই বিক্রি হয়ে যায়। লাভ হয় প্রায় ২০০-২৫০ টাকা। এ টাকায় কি সংসার চলে? তাও আবার দুই জায়গায়। একে তো ঢাকায় থাকা-খাওয়ার খরচ, অন্যদিকে গ্রামে স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মা। ৪ ভাইয়ের মধ্যে বড় তিনি। চার ভাইয়ের বউ ও এক ভাই গ্রামে। বড় ভাই হওয়ার দায়িত্বটা একটু বেশিই। বড় বোনের বিয়ে দিয়েছেন গ্রামেই।
বিয়ে করেছেন ১৫-১৬ বছর হলো। তাঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বউ বরিশালের মেয়ে। মা-বাবার সঙ্গে সেও ঢাকায় থাকত। সেই থেকে পরিচয়। পরে বউকে রেখে আসেন গ্রামে। এখন তার মা-বাবাও থাকেন গ্রামে।
পড়াশোনা করেছেন কতদূর? দীর্ঘশ্বাস ফেলেন জাকির হোসেন। বলেন, ‘নাহ, পড়াশোনা আর হলো কই। সেই যে দালাল নিয়ে এল, পরে তো আর রাগ করে বাসায় গেলাম না। পড়লামও না। ছাত্র তো খারাপ ছিলাম না। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ক্লাসে রোল ছিল এক। পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পেয়েছিলাম ট্যালেন্টপুলে। অষ্টম শ্রেণীতেও বৃত্তি দিয়েছিলাম। পড়াশোনা করতে পারলে জীবন অন্যদিকে মোড় নিত।’ কষ্টটা যেন তাঁর চোখ দিয়ে ঠিকরে বেরোচ্ছিল।
ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে না? ‘হ্যাঁ, করে তো। আমি না পড়তে পারলে কি হবে, ইচ্ছে আছে ওদের ভালোভাবে পড়াশোনা করানোর, যত কষ্টই হোক। মেয়েটি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। সেও সমাপনী পরীক্ষায় ভালো করেছে। বৃত্তিও পাবে। আমার ইচ্ছে পড়াশোনা করে ওরা মানুষের মতো মানুষ হোক।’ সূর্যের প্রচণ্ড তীব্রতা আর রাস্তার দূষিত নিঃশ্বাস নিয়ে চিত্কার করে করে সবাইকে ঠান্ডা পানীয় পান করিয়ে তৃপ্ত করতে পারলেও তৃপ্ত নন জাকির হোসেন। গ্রামে ফেরার আকুল আবেদন—মন জানান দেয় প্রতিনিয়ত। আর কত, এভাবে ঘর ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়ে থাকা? আর কত, স্ত্রী-সন্তানবিহীন একা একা থাকা? আর কত, কষ্টের সমুদ্রে দাঁড়িয়ে কূলের স্বপ্ন দেখা?
‘যদি ৫০-৬০ হাজার টাকা একসঙ্গে জমাতে পারতাম, তবে আর ঢাকায় থাকতাম না। গ্রামে চলে যেতাম। কোনো একটা ব্যবসা করতাম। দিনশেষে যখন ঘরে ফিরতাম, তখন একা একটি অন্ধকার ঘরে না থেকে স্ত্রী-সন্তানদের কিচিরমিচিরে মুখরিত হয়ে উঠতাম।’ সেই দিনটিরই হয়তো স্বপ্ন আঁকতে বসলেন জাকির হোসেন, আমাদের বিদায় দেওয়ার পর।

No comments

Powered by Blogger.