জবানবন্দিতে সাক্ষী ড. আনিসুজ্জামান-সাকা চৌধুরী একাত্তরে পাকিস্তানি মেজর হিসেবে পরিচিত ছিলেন

সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সাকা চৌধুরী) মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি মেজর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে নিরস্ত্র হিন্দু সম্প্রদায় ও স্বাধীনতার পক্ষের মানুষের ওপর সাকা চৌধুরী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ কথা বলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান।


বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন ড. আনিসুজ্জামান। গতকাল সোমবার সাকার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ড. আনিসুজ্জামান সাক্ষ্য দেওয়ার সময় সাকা চৌধুরী আসামির কাঠগড়ায় বসা ছিলেন। এ সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর মাধ্যমে বাংলাদেশে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাক্ষ্য নেওয়া হলো। এর আগে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
এদিকে সাক্ষ্যগ্রহণের প্রথম দিনে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ও সাকা চৌধুরীর মধ্যে এবং রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। সাক্ষীর বক্তব্যের সময় সাকা চৌধুরী বারবার বাধা সৃষ্টি করেন। একপর্যায়ে সাকাকে সতর্ক করে আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
ড. আনিসুজ্জামান গতকাল ট্রাইব্যুনালে বলেন, 'আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল থেকে ২২ এপ্রিল আমি ভারতের রামগড়ে ছিলাম। সম্ভবত ২০ অথবা ২২ এপ্রিলের দিকে কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয় ও কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা এবং নতুন চন্দ্র সিংহের ছোট ছেলে প্রফুল্ল সিংহের সঙ্গে আমার রামগড়ে সাক্ষাৎ হয়। প্রফুল্ল সিংহ আমাকে বলেন, আমার বাবা বেঁচে নেই। আমি ঘটনা জানতে চাইলে প্রফুল্ল বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চট্টগ্রামের রাউজান থানার কুণ্ডেশ্বরীতে প্রবেশ করে আমার বাবার সঙ্গে কথাবার্তা বলে ফিরে যাওয়ার সময় ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ইঙ্গিতে পাকিস্তানি বাহিনী আমার বাবা নতুন চন্দ্র সিংহকে গুলি করে। পরে সাকা চৌধুরীও তার পিস্তল দিয়ে গুলি করে। প্রায় তিন দিন নতুন চন্দ্রের মৃতদেহ সেখানে পড়ে ছিল। পরে আশপাশের লোকজন তাঁর সৎকার করে।'
ড. আনিসুজ্জামান বলেন, 'আমি বাহাত্তর সালের ৬ জানুয়ারি প্রথমে খুলনায় এবং ৮ জানুয়ারি ঢাকায় ফিরে আসি। এরপর আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ব পদে যোগদান করে বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করি।' তিনি বলেন, 'স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে আমি কুণ্ডেশ্বরীতে যাই তাদেরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন এবং খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য।'
আনিসুজ্জামান বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সালেহ উদ্দিনকে (বর্তমানে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি) রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা ফজলুল কাদের চৌধুরীর বাসভবন গুডস হিলে ধরে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে তাঁকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। এ নির্যাতনের সঙ্গে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীও জড়িত ছিলেন বলে সালেহ জানান। এখনো তাঁর গায়ে চিহ্ন আছে।'
এরপর ড. আনিসুজ্জামান স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দালালদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, একাত্তর সালে প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নেয়। এ দেশের কিছু রাজনৈতিক দলের নেতারা এ হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন, যাঁদের মধ্যে গোলাম আযম, নিজামী, ফজলুল কাদের চৌধুরী নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন।'
আনিসুজ্জামানের জবানবন্দি শেষ হলে সাকার আইনজীবী অ্যাডভোকেট আহসানুল হক হেনা ও ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম তাঁকে জেরা করা শুরু করেন। জেরার শুরুতে উভয় পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে আহসানুল হক হেনা সময়ের আবেদন জানিয়ে বলেন, 'এ সাক্ষীর তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া এবং আদালতে দেওয়া জবানবন্দির মধ্যে মিল নেই। সুতরাং, এ বিষয়ে জেরা করতে হলে আমাদের সময় দিতে হবে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য।'
ট্রাইব্যুনাল বলেন, 'সময় দেওয়া হবে না। এখনই জেরা শুরু করতে হবে। আপনারা বসে বসে যে নোট করেছেন তা থেকে জেরা করেন।'
এরপর আইনজীবী ফখরুল ইসলাম সাক্ষী আনিসুজ্জামানকে প্রশ্ন করেন, 'পশ্চিমবঙ্গের কোথায় আপনার জন্ম?'
উত্তরে সাক্ষী বলেন, পশ্চিমবঙ্গের পার্ক সার্কাসে।
আসামিপক্ষের আইনজীবী জানতে চান, আনিসুজ্জামান ভারত থেকে চলে আসার পর পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকত্ব কবে গ্রহণ করেছিলেন।
এ সময় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, 'এ প্রশ্ন্ন করা যাবে না। কারণ এর সমাধান নির্দিষ্ট আইনেই করা হয়েছে। আজ এ প্রশ্ন করার কিছু নেই।'
সাকার চিৎকার : তখন আসামির কাঠগড়ায় বসা সাকা চৌধুরী দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেন, 'কেন যাবে না? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।' জবাবে ট্রাইব্যুনাল বলেন, 'মিস্টার চৌধুরী, আপনি শান্ত হন।' তখন সাকা চৌধুরী বলেন, 'মিস্টার নিজামুল হক, উইথ অল ডিউ রেসপেক্ট, ডোন্ট শো ইয়র রেড আইস (যথাযথ সম্মানপূর্বক বলছি, চোখ রাঙাবেন না)।'
এ পর্যায়ে উভয় পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে বাগ্‌বিতণ্ডা শুরু হয়ে যায়। এ অবস্থায় আদেশ দেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান।
সাকা সব সময়ই চিৎকার করেন : লিখিত আদেশে বলা হয়, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী হচ্ছেন অভিযুক্তদের মধ্যে এমন একজন, যিনি সব সময়ই এজলাসকক্ষে চিৎকার করেন। এ ব্যাপারে আগে বিভিন্ন সময় লিখিত আদেশও দেওয়া হয়েছে। তার পরও তাঁর এমন আচরণ অব্যাহত রয়েছে। তিনি কাঠগড়া থেকে অনবরত কথা বলে যেতে থাকেন। এমন না করার জন্য বিভিন্ন সময় ট্রাইব্যুনাল তাঁকে অনুরোধও করেছেন।
এমন করলে তাঁকে ছাড়াই বিচারকাজ চলবে : আদেশে আরো বলা হয়, 'অভিযুক্ত ব্যক্তি কখনোই কাঠগড়া থেকে কথা বলতে পারেন না। যখন অভিযুক্তের আইনজীবী নিয়োগ থাকেন, তখন তিনি আর কথা বলতে পারেন না। আমরা শেষবারের মতো তাঁকে সতর্ক করলাম। তিনি যদি এ রকম করতেই থাকেন, তাহলে তাঁকে ছাড়াই বিচারকাজ চলবে।' আদেশে বলা হয়, আজ মঙ্গলবার আবার সাক্ষ্যগ্রহণ চলবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাকা চৌধুরী এমপির বিরুদ্ধে একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় গণহত্যা, ধর্ষণসহ ৯ ধরনের মোট ৭৭টি অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ থেকে তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে ১৫টি গণহত্যা, একটি ধর্ষণ, আটটি হত্যা, ১১টি নির্যাতন, ৯টি অপহরণসহ মোট ৭৭টি অভিযোগের কথা বলা হলেও ট্রাইব্যুনাল গত ৪ এপ্রিল ২৩টি ঘটনায় সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
২০১০ সালের ২৬ জুলাই সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করা হয়। তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য একই বছরের ১৫ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালে আবেদন করে তদন্ত সংস্থা। পুলিশ তাঁকে গাড়ি ভাঙচুরের মামলায় ১৬ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করলেও ট্রাইব্যুনাল ১৯ ডিসেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখান। গত বছর ৪ অক্টোবর তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত সংস্থা। এরপর ১৪ নভেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে ৫৫ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করে প্রসিকিউশন।

No comments

Powered by Blogger.