পাটকল চালুর প্রশংসনীয় উদ্যোগ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শনিবার খুলনায় খালিশপুর জুট মিলের কার্যক্রম উদ্বোধন করেছেন। আগে এর নাম ছিল পিপলস জুট মিল। বিগত জোট সরকারের আমলে আদমজী জুট মিলসহ যে পাঁচটি জুট মিল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, এটি ছিল তার মধ্যে একটি।


শনিবার সেখানে এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বন্ধ থাকা আরো সাতটি পাটকল দ্রুত চালু করা হবে। তিনি জানান, এরই মধ্যে শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধের জন্য এক হাজার ২৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া কারখানাগুলোর তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ মওকুফ করা হয়েছে। পাটশিল্পের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে বর্তমান সরকারের এ উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই।
পাটকে একসময় বলা হতো বাংলাদেশের সোনালি আঁশ। সেই সোনালি আঁশের গৌরব অনেক আগেই ম্লান করে দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মুখে এ দেশের পাটশিল্প প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে যেখানে ৭৭টি পাটকল রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়েছিল, সেখানে এখন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাটকলের সংখ্যা এক-চতুর্থাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। বড় পাটকলগুলোর প্রায় সবই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং নামমাত্র মূল্যে ব্যক্তিমালিকানায় দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর থেকেই পাটশিল্প তথা রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানার বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এরশাদের আমলে নতুন শিল্পনীতির আওতায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ৬৫০টি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে জুট মিল ছিল ২৯টি। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বিএনপি সরকারের আমলেও ছয়টি জুট মিল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৯৯১ সালে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গঠিত টাস্কফোর্সের রিপোর্টে বেসরকারি খাতে বিক্রির একটি করুণ চিত্র পাওয়া যায়। তাদের মতে, এর আগে বিক্রি করা ২৯টি পাটকলের মূল্য ছিল ২৪৫ কোটি টাকার ওপরে, কিন্তু সেগুলো বিক্রি করা হয়েছে মাত্র সাড়ে পাঁচ কোটি টাকায়।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ দাতা সংস্থাগুলোর পরামর্শে তথাকথিত বেসরকারীকরণের প্রক্রিয়ায় শুধু যে এ দেশের পাটশিল্প ধ্বংস হয়েছে, তা নয়; লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছেন। এমনকি বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও চারটি পাটকল বন্ধ এবং ১৮টি পাটকল থেকে আট হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ছাঁটাইয়ের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছিল। সে সময় খুলনায়ই বিভিন্ন সংগঠন লঙ্গরখানা খুলে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিক-কর্মচারী ও তাঁদের পরিবার-পরিজনকে কিছুদিন ভরণপোষণ করেছিল। কারণ ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের পাওনা বুঝিয়ে না দেওয়ায় তাঁরা মিল এলাকা ছেড়ে যেতে পারছিলেন না। বর্তমান সরকার বন্ধ পাটকলগুলো চালু করার যে ব্যতিক্রমী ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে, তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু কেবল বন্ধ পাটকল চালু করলেই হবে না, অতীতের ভুলত্রুটি ও ষড়যন্ত্র থেকে এ শিল্পকে মুক্ত করতে হবে। এসবের মধ্যে রয়েছে মৌসুমে সময়মতো পাট না কেনা এবং পরে ফড়িয়াদের কাছ থেকে বেশি দামে পাট কেনা, কর্মসময়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকা, রাজনৈতিক লোকবল নিয়োগ ও অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বেশি হওয়া, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ইত্যাদি। ইউনিয়ন যেন অতীতের মতো কোথাও সমস্যার কারণ না হয়, সে জন্য সরকার, শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের সচেতন থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, ট্রেড ইউনিয়নগুলোর দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে এ ধরনের উদ্যোগ বারবার নেওয়া হবে না। কাজেই বর্তমান সরকারের এ উদ্যোগকে দ্রুত সফল করতে হবে। আমাদের বোধগম্য নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতে যদি পাটশিল্প প্রতিনিয়ত উন্নতি করতে পারে, লাভ করতে পারে, তা হলে আমাদের দেশে পাটশিল্প কেন লাভজনক হবে না? বিশেষ করে সারা দুনিয়ায় যখন পরিবেশবান্ধব পাটজাত পণ্যের চাহিদা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পাট আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের পরিচিতির অংশ। আমরা পাটের জেনোম আবিষ্কার করেছি। উন্নত পাটবীজ উৎপাদনের গবেষণা চলছে। পাশাপাশি পাটজাত পণ্যের উৎকর্ষের জন্যও ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। সদিচ্ছা থাকলে এই পাটশিল্পের উন্নয়নে আমরা অবশ্যই এগিয়ে যাব।

No comments

Powered by Blogger.