চারদিক-মনকাড়া বাঁশির সুর by কল্যাণ প্রসূন

সিলেটে যাব জরুরি কাজে। কুলাউড়া রেলস্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। লোকজনের ভিড় থাকায় হইচই হচ্ছিল। এরই মধ্যে কোথা থেকে যেন বাঁশির করুণ সুর কানে ভেসে এল। কারও মুঠোফোনে ‘রিংটোন’ বাজছে হয়তো—এই ভেবে আর সেদিকে খেয়াল করিনি।


টিকিট কেটে স্টেশন চত্বরে ঢুকে দেখি, এক পাশের পাকা মেঝেতে গামছা পেতে বসে আপন মনে বাঁশি বাজাচ্ছে এক কিশোর। এবার বুঝলাম সুরের রহস্য। সেখানে জটলা করেছে অপেক্ষমাণ কিছু ট্রেনযাত্রী। একদিকে তারা বাঁশির সুর শুনছে, অন্যদিকে বিস্ময়ে কিশোরটির দিকে তাকিয়ে আছে।
কাছে এগোই। জানলাম, কিশোরটির চোখের আলো নেই। তবে তার বাঁশিতে তোলা সুরের আলো যে মানুষের মন কেড়েছে, তা বুঝতে বাকি রইল না। যাত্রীদের কেউ কেউ সুর শুনে মুগ্ধ হয়ে এক-দুই টাকা করে সামনে পেতে রাখা গামছায় ছুড়ে দিচ্ছে।
সেদিন ভাপসা গরমও পড়েছিল। কিশোরটির শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছে। বাঁশি রেখে এক টুকরো কাপড় দিয়ে চোখ-মুখের ঘাম মুছতে লাগল সে। কর্তব্যরত স্টেশনমাস্টারকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম ট্রেন পৌঁছাতে এখনো ঘণ্টা খানেক দেরি। এই ফাঁকে বংশীবাদকের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলাম। তার নাম বাবুল তংলা। ১৪ বছর বয়স। বাবার নাম রাখাল তংলা। বাড়ি কুলাউড়া উপজেলার গাজীপুর চা-বাগানের ৭ নম্বর সেকশন এলাকায়।
বাবুল বলতে লাগল, ‘বাবা (রাখাল) বাঁশি বাজাইত শুনতাম। তারে কইলাম, আমারে একটা বাঁশি আনিয়া দেও। বাবা আনি দিল। বাবাই আমার উস্তাদ। তার কাছ থাকিই বাজানিটা শিখছি। যেকোনো গান দুই-একবার শুনলে সুর উঠাইতে পারি।’ এই বলে আবারও সে বাঁশিতে সুর ধরল। প্রয়াত বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের লেখা ও সুর করা গান ‘আমি কূলহারা কলঙ্কিনী, আমারে কেউ ছুঁইয়ো না গো সজনী...’। চমৎকার বাজাল। সুরে বেশ দরদ আছে।
বাবুল জানাল, শাহ আবদুল করিম, রাধারমণ আর হাসন রাজার গান তার খুব পছন্দের।
লেখাপড়া করার ইচ্ছা আছে তোমার?—জানতে চাই।
‘চউখের যে আলো নাই। থাকলে তো লেখাপড়াই করতাম।’ বলতে বলতে তার দুই চোখ জলে ভরে উঠল। বাবুল গর্ব করে বলল, ‘অন্ধরা তো ভিখ (ভিক্ষা) করইন শুইনছি। অন্ধ অইয়া আমি ইটা করি না। বাঁশি বাজাই। মাইনষে খুশি অইয়া যা দেয় নিই। এইটাই যথেষ্ট।’
সে জানায়, বাঁশি বাজিয়ে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৪০০ টাকা পাওয়া যায়।
বাবুলের সঙ্গে কথা বলে পাশের রেলওয়ে বুকস্টল ও সংবাদপত্র বিক্রয়কেন্দ্রে গিয়ে বসি। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মহসিন আহমেদ চৌধুরী চায়ের আমন্ত্রণ জানালেন। চা পানের পাশাপাশি বাবুলকে নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। মহসিন ভাই বললেন, ‘ছেলেটা এখানে প্রায়ই আসে। দরদ দিয়ে বাঁশি বাজায়। আমিও শুনি। অসম্ভব ভালো লাগে।’
তাঁর কথায় সায় দেন পাশে দাঁড়ানো কয়েকজন হকার।
খবর পেয়ে বাবুলের বাবা রাখাল বুকস্টলে ছুটে আসেন; জানালেন, তিনি দিনমজুরের কাজ করেন। ছেলেকে (বাবুল) নিয়ে তিনি প্রতিদিন সকালে কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা, শ্রীমঙ্গলসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় যান। যেখানে লোকসমাগম বেশি হয়, সেখানে বাবুলকে বসিয়ে দিয়ে তিনি কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। সন্ধ্যা নামলে বাড়ি ফেরেন। তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মী তংলা গাজীপুর চা-বাগানে শ্রমিকের কাজ করেন। বাবুল ছাড়াও তাঁদের আরও দুই মেয়ে আছে। বড় মেয়ে স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে।
রাখালের ভাষ্যমতে, বাবুল জন্মান্ধ। দু-তিন বছর আগে এক পথচারীর পরামর্শে বাবুলকে নিয়ে তিনি কুলাউড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যান। সেখানকার চিকিৎসকেরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান, অস্ত্রোপচার করে বাবুলের দৃষ্টি ফেরানো সম্ভব নয়। এর পর থেকে এই আশা আর ছেড়ে দেন রাখাল।
রাখাল হতাশ হয়ে বলেন, ‘ছেলেটা চউখে দেখতে পারলে আমিই সবচেয়ে খুশি অইতাম। কিন্তু সেই ভাগ্যটা কি আর আছে আমার!’
এরই মধ্যে ট্রেন ঢুকে পড়েছে স্টেশনে। রাখাল আর মহসিন ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ি। খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই বাবুলের দিকে। বাঁশি হাতে আনমনা বসে আছে। যাত্রাবিরতির পর ট্রেন চলতে থাকে। ভাবতে থাকি, বাবুল কি পৃথিবীর আলো কোনো দিন দেখতে পাবে!
কল্যাণ প্রসূন
জুড়ী, মৌলভীবাজার

No comments

Powered by Blogger.