পুলিশের ঘুষ দুর্নীতি-পচন ধরেছে ওপরতলায় by মহিউদ্দিন আহমদ

প্রথম আলো পরপর দুই দিন দুটো ছবি ছেপেছে। একটি ছবি ঢাকার কাছে আশুলিয়া থেকে তোলা, পুলিশের এক সদস্য নির্দয়ভাবে পেটাচ্ছেন একজন পোশাকশ্রমিককে। অন্য ছবিটি চট্টগ্রামের, একজন পোশাকশ্রমিক নির্দয়ভাবে পেটাচ্ছেন পুলিশের এক সদস্যকে। পুলিশ এবং পোশাকশ্রমিক দুজনেরই ক্ষোভ আছে।


একজন আরেকজনকে প্রতিপক্ষ বা শত্রু মনে করছেন এবং এই আচরণের পক্ষে হাজারো যুক্তি খাড়া করছেন।
আমাদের সমাজে কারণে-অকারণে মানুষ মানুষকে পেটায়। এদের মোটা দাগে দুই দলে ভাগ করা যেতে পারে। এক ধরনের মানুষ মনে করে, অন্যকে আঘাত করা তার সামাজিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। এরা অহংকারী। অন্যকে আঘাত করে এরা নিজেদের ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশ করে। আরেক দলে আছেন এমন মানুষ, যাঁরা নিজেদের বঞ্চনার শিকার মনে করেন। তাঁদের মনে দুঃখ, হতাশা, ক্রোধ এবং ক্ষোভ জমা হতে হতে একসময় বিস্ফোরণ ঘটায়। আমার মনে হয়, সাম্প্রতিক সময়ের যে প্রতিফলন আমরা উল্লিখিত ছবি দুটোতে দেখি, তা দ্বিতীয় ধরনের। অর্থাৎ বঞ্চনা, হতাশা ও ক্ষোভ থেকে জন্ম নেওয়া সহিংস আচরণ। বিবৃতি দিয়ে কিংবা উপদেশ খয়রাত করে এর মীমাংসা করা যাবে না।
পুলিশ, বিশেষ করে পুলিশ কনস্টেবল, যাঁদের আমরা মাথায় হেলমেট, এক হাতে বর্ম এবং অন্য হাতে লাঠি দেখি, তাঁদের ও পোশাকশ্রমিকদের মধ্যে অনেক মিল। তাঁরা প্রায় সবাই এসেছেন দরিদ্র পরিবার থেকে, তাঁদের একাডেমিক শিক্ষা খুব বেশি নয়, বড় জোর হাইস্কুলের কোনো ধাপ কিংবা মাধ্যমিক পাস এবং তাঁদের অনেকেরই আত্মীয়স্বজন এই উভয় পেশার সঙ্গে সম্পর্কিত। আমি এখানে যে কথাটি বলতে চাই, তা হলো, তাঁরা মোটামুটি একই শ্রেণীভুক্ত।
পোশাকশ্রমিকের মূল দ্বন্দ্ব তাঁর মালিক বা ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে। সেখানে যখন তিনি তাঁর বঞ্চনার সুরাহা করতে পারেন না, তিনি তখন কারখানার ভেতরে দলবল নিয়ে আসবাব কিংবা যন্ত্রপাতি ভাঙেন। চোখের সামনে মালিককে দেখলে হয়তো তাঁকেই হেনস্তা করতেন। কিন্তু মালিক তো কাজে অন্যত্র ব্যস্ত। তিনি হয়তো তখন রপ্তানির কাজে বিদেশ সফর করছেন, অথবা জাতীয় সংসদে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মুণ্ডু কেটে নিচ্ছেন, অথবা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আছেন। তাঁরা ব্যস্ত থাকেন বলেই আমাদের অর্থনীতির ব্যারোমিটারের পারদ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে।
পোশাকশ্রমিক কারখানার ভেতর ভাঙচুর করে ক্ষান্ত হন না। মাঝেমধ্যে বাইরে এসে রাস্তা অবরোধ করেন, বাস-ট্রাক-গাড়ি সামনে যা পান, তাতেই আক্রমণ করেন। ফলে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ কষ্ট পায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যিনি ক্ষতিগ্রস্ত হন, তিনি সম্ভবত জীবনেও আর পোশাকশ্রমিকদের পক্ষ নিয়ে কথা বলবেন না, লড়াই করা তো দূরে থাক। এই সহিংস আচরণের কারণে পোশাকশ্রমিকেরা ব্যাপকসংখ্যক নাগরিকের সহানুভূতি ও সমর্থন হারাচ্ছেন, যাঁরা হতে পারতেন তাঁদের ন্যায়সংগত লড়াইয়ের সহযাত্রী।
পুলিশের অবস্থাও একই রকম। তবে নিরাপদ সরকারি চাকরির তকমা থাকার কারণে তাঁরা তাঁদের মালিক অর্থাৎ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে শামিল হতে পারেন না। কিন্তু ক্ষোভের প্রকাশ তো থাকবেই। সেটা গিয়ে পড়ে রাজনৈতিক কর্মী কিংবা পোশাকশ্রমিক অথবা ছাত্রদের ওপর। এমনকি শিক্ষক-সাংবাদিকও রেহাই পান না। একজন পুলিশ কনস্টেবল, অথবা নিচু পদে চাকরি করেন এমন কর্মকর্তা যে রকম পরিবেশে থাকেন বা কাজ করেন, তা একজন পোশাকশ্রমিকের চেয়ে খুব একটা উন্নত মানের নয়।
পুলিশের বেতন কম, কাজের কোনো সময়সীমা বা রুটিন নেই। থাকলেও যখন তখন ‘জরুরি’ কাজে পুলিশসদস্যের তলব পড়ে। তাঁর ওপর দায়িত্ব পড়ে একটা সহিংস ‘মব’ বা ‘ক্রাউড’কে মোকাবিলা করার। সেখানে তাঁর পক্ষে বেশিক্ষণ মাথা ঠান্ডা রেখে ইট-পাটকেল হজম করা সম্ভব হয় না। টেলিভিশনের পর্দায় আমরা মাঝেমধ্যে দেখি, পুলিশ অকারণে মানুষের ওপর চড়াও হয়েছে। আবার এমন দৃশ্যও বিরল নয়, পিছু হটাতে হটাতে দেয়ালে তাঁদের পিঠ ঠেকে গেছে। তখন তাঁরা ‘আক্রমণকারীদের’ ওপর চড়াও হন। আমরা যেমন পুলিশের হাতে মার খাওয়া রক্তাক্ত শ্রমিকের ছবি দেখি টেলিভিশনের পর্দায়, তেমনি দেখি শ্রমিকের ছোড়া ইটের টুকরোর আঘাতে রক্তাক্ত পুলিশের ছবি।
একজন ট্রাফিক পুলিশের উদাহরণ দেওয়া যাক। তিনি রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বিশৃঙ্খল শহরের বিশৃঙ্খল যানবাহন নিয়ন্ত্রণের কষ্টকর কাজটি করেন। তাঁর ক্ষুধা পায়, তেষ্টা পায়, তাঁর ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু এসব প্রয়োজন মেটানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। আমরা তাঁদের কাছে নিখুঁত কাজ চাই। কথায় কথায় আমরা হংকং-সিঙ্গাপুরের পুলিশের সঙ্গে আমাদের পুলিশের তুলনা করি। পুলিশের কষ্টটা আমরা দেখি না। তিনি কোনো ট্রাকচালকের কাছ থেকে ১০ টাকা নিয়েছেন, সেটা আমরা ফলাও করে বলি।
ট্রাফিক পুলিশসদস্য ১০ টাকা ২০ টাকা নেন। একজন গাড়িমালিক তাঁর গাড়ির কাগজপত্র সময়মতো ঠিকঠাক করে রাখেননি। তিনি আইন ভেঙেছেন। পথে পুলিশ তাঁকে যদি ধরে, তিনি হয়তো ১০০ টাকা দিয়ে ম্যানেজ করলেন। গাড়িমালিক একজন হোয়াইট কলার এলিট। তিনি হয়তো কোনো একাডেমির ফেলো কিংবা বড় ব্যবসায়ী। তিনি আইন ভাঙার স্পর্ধা রাখেন। তিনি আইন ভাঙেন বলেই পুলিশ অনৈতিক কাজের সুযোগ পান।
পোশাকশ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার আছে। আইএলওর মান্ধাতার আমলের একটা কনভেনশনের বলে যেকোনো লোক, যিনি নিজে জীবনে একটি কুটোও নাড়েননি, তিনি ট্রেড ইউনিয়নের নেতা হয়ে যেতে পারেন এবং জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে শ্রমিকদের কারখানার বাইরে এনে গাড়ি ভাঙচুর করাতে পারেন। এটাকে তাঁরা বলেন ‘আন্দোলন’। প্রায় সব সরকারি অফিসের কর্মচারীদের ইউনিয়ন আছে। তাঁরা ইচ্ছে করলেই দেশটাকে অচল করে দিতে পারেন। চিকিৎসক, শিক্ষক, বিমানচালক, ট্রাক-বাসচালক, তাঁরা যখন-তখন কাজ বন্ধ করে লাখ লাখ মানুষকে জিম্মি করে ফেলতে পারেন। তাঁরা যা পারেন, পুলিশের সদস্যরা তা পারেন না।
আমাদের মতো একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিনিয়োগ বাড়ানো। দেশ কিংবা বিদেশ, যেখান থেকেই পুঁজি সংগ্রহ করা হোক না কেন, বিনিয়োগকারীর কাছে প্রধান শর্ত হলো নিরাপত্তা। একটা টালমাটাল ও অস্থির সমাজে কেউ বিনিয়োগ করতে চাইবেন না। সে জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা। এ কাজটি নির্ভর করে পুলিশ বাহিনীর ওপর। আমাদের পুলিশ এ কাজটি কতটুকু করতে পারছেন?
পুলিশের বিরুদ্ধে আমাদের অনেক অভিযোগ। তারা মানবাধিকার বোঝে না, মানে না। তারা ঘুষ নেয়। তারা মানুষকে নির্যাতন করে। কিন্তু পুলিশকে সম্মান নিয়ে সমাজে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম যা প্রয়োজন, আমরা তা নিয়ে কতটুকু ভাবি?
কয়েক বছর আগে টিআইবির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, পুলিশ সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা। এর আগে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি। আমরা কিন্তু সে জন্য শিক্ষামন্ত্রী এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী অথবা শিক্ষক এবং চিকিৎসকের দিকে তর্জনী তুলে ধরিনি। পুলিশের ব্যাপারে আমরা বোধহয় একটু বেশি রকম নির্মম।
পুলিশ বাহিনী কিংবা অন্যান্য দপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের দিয়ে প্রজেক্ট বানিয়ে পুলিশের সংস্কার করা যাবে না। যাঁরা এসব প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের অনেকেই তাঁদের দীর্ঘ চাকরিজীবনে একটা ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন বলে শুনিনি। পুলিশকে ভালো করতে হলে, তার দক্ষতা বাড়াতে হলে, তাকে আরও সংবেদনশীল করতে হলে সবার আগে দুটো জিনিস প্রয়োজন। প্রথমত, তার সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে হবে। সমাজে তার অবস্থান এমন হবে যে মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করবে, ভালোবাসবে, ভয় পাবে না, ঘৃণা করবে না। দ্বিতীয়ত, নতুন প্রজন্মের মেধাবী ছেলেমেয়েদের পুলিশ বাহিনীতে আকৃষ্ট করতে হবে। শুধু পুলিশ আইনের সংস্কার নয়, পুরো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ঢেলে সাজাতে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে সম্মানজনক সরকারি চাকরিগুলোর অন্যতম হলো পুলিশের চাকরি। পুলিশের গায়ে হাত দেওয়া সেখানে একটা বড় অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। আমরা কি পারি না আমাদের দেশের পুলিশকে ওই পর্যায়ে নিয়ে যেতে?
ঘুষ, দুর্নীতি ও অন্যান্য অপরাধের বোঝা পুলিশকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে কারণে-অকারণে। আমাদের দেশে একজন পুলিশ কনস্টেবল যে পরিমাণ ঘুষ খান বলে মানুষের ধারণা, একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ঘুষ নেন তার হাজার গুণ বেশি। এই ধারণা সাধারণ মানুষের।
আমি বিশ্বাস করি, ঘুষ দুর্নীতি দূর করা সম্ভব। সরকারপ্রধান যদি সৎ হন, তাঁর মন্ত্রী অসৎ হতে পারেন না। মন্ত্রী যদি সৎ হন, তাঁর সচিব অসৎ হতে পারেন না। একজন সচিব বা প্রতিষ্ঠানের প্রধান যদি সৎ হন, তাঁর প্রতিষ্ঠানের অন্য কেউ অসৎ হতে পারেন না। আমি ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকে এই উচ্চারণ করছি। আমি আবারও বলছি, পুলিশ বাহিনীর সংস্কার প্রয়োজন এবং সম্ভব। তবে সে জন্য যা যা প্রয়োজন সেগুলো আগে করতে হবে। সমাজে পচন ধরেছে ওপরতলায়। সেখানে হাত লাগাতে হবে আগে।
আমাদের আরও কিছু বিষয় ভেবে দেখা দরকার। বুড়িগঙ্গা-তুরাগ-শীতলক্ষ্যা নদীর মৃত্যু পুলিশের হাতে হয়নি। ভোটের দিন পুলিশ ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে না। বড় বড় ঠিকাদারির কমিশনে পুলিশ ভাগ পায় না। জাল সার্টিফিকেট দিয়ে যিনি হাইকোর্টের বিচারক হন, তিনি পুলিশের সদস্য নন। একটি পরীক্ষায়ও প্রথম বিভাগ না পেয়ে যাঁরা অধ্যাপক এবং উপাচার্য হয়েছেন, তাঁরাও পুলিশের সদস্য নন। আমাদের সমাজের বড় অপরাধগুলো যাঁরা করেন, তাঁদের মধ্যে পুলিশ কয়জন? আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে পুলিশ বাহিনী সর্বপ্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ একজন পুলিশ। আমরা এই গৌরবগাথায় কালি ছিটানোর সুযোগ কেন দেব?
 মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.