সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস-সিধু, কানু, চাঁদদের কথা by জাহাঙ্গীর হোসেন

পাহাড়িদের নিয়ম ছিল_যে যতটুকু জঙ্গল পরিষ্কার করে আবাদ বা বসবাসের জন্য তৈরি করতে পারবে, ততটুকুর মালিক সে। আর এই নিয়মে চলছিলও সুখে-স্বচ্ছন্দে। ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে সাঁওতালরা দামনে কোহ (রাজমহল, পাহাড়তলী) এলাকায় জীবিকার তাগিদে বসবাস শুরু করে।


সেখানকার উর্বর পাহাড়ি জমি চাষে তারা ধীরে ধীরে দক্ষতার ছাপ রাখে। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় সাঁওতালরা ছিল সবচেয়ে বড় উপজাতি। এরা চাষাবাদ করত এবং পণ্য বিনিময় করেই চাহিদা মেটাত। ধীরে ধীরে ব্যাপারিরা এসে নানা চমকপ্রদ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি করতে শুরু করলেন। শুরু থেকেই তাঁরা বুঝে গেলেন, এই পাহাড়িরা বড়ই সরল। তাই অনেক ফসল নিয়ে বিনিময়ে দিতেন সামান্য লবণ, তেল ইত্যাদি। শুধু কি তা-ই! পণ্য কেনার সময় মাপা হতো বড় পাথর বা কেনারাম (নাম ছিল বড়বৌ) আর বিক্রির সময় মাপা হতো ছোট পাথর বা বেচারাম (নাম ছিল ছোটবৌ) দিয়ে। নতুন কোনো পরিবার এলাকায় এসে চাষাবাদ শুরু করলে শুরুতে তাদের খাবার বাবদ ধান ধার দিতেন ব্যবসায়ীরা। পরে সাঁওতালরা জঙ্গল পরিষ্কার করে জমি চাষ করার পর এর দখলদারি নিতেন ব্যবসায়ীরা। ব্যাপারিদের জুলুম সহ্য করতে না পেরে কেউ যদি জঙ্গলে গা-ঢাকা দিত, তাহলে বেপারিরা আদালতে ঘুষ দিয়ে তার বিরুদ্ধে ডিক্রি জারি করাতেন। তার গবাদিপশুসহ সব কিছু ছিনিয়ে নিতেন। এমনকি সাঁওতালদের স্ত্রীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় বাঁধন যে হাতে লোহার বালা, তা-ও ছিনিয়ে নেওয়া হতো। এ এলাকায় ইংরেজদের যে জজ নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, তিনি শুধু রাজস্ব আদায় নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। অন্য কিছু দেখার তাঁর মানসিকতা ছিল না। এই সুযোগে সরকারি পুলিশ, কর্মকর্তা-কর্মচারী_সবাই যথেচ্ছ দুর্নীতি শুরু করেছিলেন। ১৮৪৮ সালে অনেক সাঁওতাল অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গহিন জঙ্গলে চলে যায়। আর যারা রয়ে গেল, তারা হয়ে গেল ব্যবসায়ীদের গোলাম। ১৮১১, ১৮২০, ১৮৩১ সালে সাঁওতালদের খণ্ড খণ্ড বিদ্রোহ হয়েছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অত্যাচারের মাত্রাও বাড়তে লাগল। দিনের পর দিন অত্যাচারের শিকার হয়ে নিরীহ সাঁওতালরা বিদ্রোহ করল। ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন ভাগনাদিহির মাঠে ১০ হাজার সাঁওতাল একত্র হলো দুই নির্ভীক ভ্রাতা সিধু ও কানুর নেতৃত্বে। এই বিদ্রোহে আরো হাজার হাজার সাঁওতাল যোগ দিল। বন্ধ হয়ে গেল সরকারের ডাক যোগাযোগ। ভয়ে পালিয়ে গেলেন জমিদার ও ম্যাজিস্ট্রেট। ইংরেজ সরকার এই বিদ্রোহ থামাতে গেলে তাতে আগুনে ঘি দেওয়ার মতো ফল হয়। এই বিদ্রোহে সহযাত্রী হয় তেলি, চর্মকার, ডোম ও মুসলমানরা। সাঁওতালদের তীর ও অন্যান্য অস্ত্রের মুখে পিছু হটে ইংরেজ সরকার। পরে সব শক্তি প্রয়োগ করা হয় বিদ্রোহ দমনে। অশ্বারোহী, হস্তীবাহিনী, কামান ও পদাতিকের মতো অত্যাধুনিক অস্ত্রের মুখে কঠোরভাবে দমন করা হয় এই বিদ্রোহ। সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরবের মতো বিদ্রোহী নেতা প্রাণ দিয়ে বীজ বুনে যান স্বাধীনতার। আজ বিনম্র ও সশ্রদ্ধচিত্তে ওই বীরদের স্মরণ করছি।
জাহাঙ্গীর হোসেন

No comments

Powered by Blogger.