আ.লীগের সাংগঠনিক গতি কমেছে, বেড়েছে কোন্দল by জাহাঙ্গীর আলম

ক্ষমতার সাড়ে তিন বছরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম গতি পায়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে স্থবিরতা বা অন্তঃকোন্দল বেড়েছে বলে দলটির বিভিন্ন পর্যায় থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া একশ্রেণীর নেতা-কর্মী চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিতে জড়িয়ে প্রায়ই সংবাদ শিরোনাম হয়েছে।


চাওয়া-পাওয়াকে কেন্দ্র করে খুনোখুনি পর্যন্ত হয়েছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ৭২টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে অন্তত ৩০ জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। ১৮টি জেলা কমিটির সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক নেই। চারটি জেলায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দুটি পদই খালি। ১০টি জেলায় কাউন্সিল হয় না ১৫ বছর ধরে।
৪৬০টি উপজেলা কমিটির মধ্যে ৪৫৬টি কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে তিন-চার বছর আগেই। অনেক উপজেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই, বছরের পর বছর ভারপ্রাপ্তদের দিয়ে দলীয় কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ২৪ জুলাই। এই কমিটি গত তিন বছরে মাত্র চারটি উপজেলায় কাউন্সিল করতে সক্ষম হয়েছে। উপজেলাগুলো হলো টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা, সিরাজগঞ্জের বেলকুচি ও কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা। এ সময়ে কোনো জেলা কমিটির কাউন্সিল হয়নি।
দলীয় সূত্রগুলো জানায়, বর্তমান কমিটি কয়েক দফা জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কাউন্সিলের উদ্যোগ নিয়েছিল। সর্বশেষ চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি মধ্যে ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কাউন্সিল শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এরপর আরও ছয় মাস পার হতে চলেছে, এখন পর্যন্ত সব ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটির কাউন্সিল শেষ করতে পারেনি। আর চলতি বছরের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে উপজেলা কমিটির কাউন্সিল শেষ করার কথা থাকলেও এই সময়ে মাত্র চারটি উপজেলার কাউন্সিল হয়েছে। আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে জেলা কমিটির কাউন্সিল শেষ করার সময় দেওয়া আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি জেলায়ও কাউন্সিল হয়নি।
জানতে চাইলে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ দাবি করেন, ‘ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে ৬০ শতাংশ কাউন্সিল শেষ হয়েছে। শতাধিক উপজেলা কাউন্সিলের জন্য প্রস্তুত আছে। বেশ কয়েকটি জেলাও দ্রুত কাউন্সিল শেষ হবে। তৃণমূলের কাউন্সিল শেষ করে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই কেন্দ্রীয় কাউন্সিল করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
দলীয় নেতারা জানান, আগামী ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কাউন্সিল করার লক্ষ্যে দ্রুত মাঠপর্যায়ে কাউন্সিল করতে জেলা ও উপজেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সাংসদদের কাছে চিঠি দিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
দেড় যুগেও কাউন্সিল হয়নি ১০ জেলায়: গত দেড় যুগেও আওয়ামী লীগের ১০টি সাংগঠনিক জেলা কমিটির কাউন্সিল করতে পারেনি দলটি। জেলাগুলো হলো কিশোরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা উত্তর ও দক্ষিণ, ফেনী, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরিশাল জেলা ও মহানগর এবং সুনামগঞ্জ। ১৯৯৭ সালের পর এসব কমিটির কাউন্সিল হয়নি।
এ ছাড়া নোয়াখালী, জামালপুর, নেত্রকোনা, ঢাকা মহানগর, গোপালগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, সিরাজগঞ্জ, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা উত্তর ও কক্সবাজার জেলায় সভাপতি নেই। কিশোরগঞ্জ, দিনাজপুর, সুনামগঞ্জ ও ফেনী জেলা কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুটি পদই শূন্য। ভারপ্রাপ্তরা দায়িত্ব পালন করছেন।
সাংগঠনিক স্থবিরতা: দেশের সাত বিভাগে মহাসমাবেশ করবে বলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত ছিল। আগামী মাসে কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেবল তিনটি বিভাগ সিলেট, বরিশাল ও চট্টগ্রামে মহাসমাবেশ হয়েছে।
গত সাড়ে তিন বছরে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম অনেকটা স্থবির ছিল বলে দলের ভেতরেই আলোচনা আছে। উপরন্তু অভ্যন্তরীণ দলাদলি আর চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিতে জড়িয়ে পড়েন একশ্রেণীর নেতা-কর্মী। সারা দেশেই তৃণমূলের নেতৃত্বে নানা পক্ষের সৃষ্টি হয়েছে। অনেক এলাকায় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে সংগঠনের দূরত্ব বেড়েছে।
অবশ্য স্থবিরতার কথা স্বীকার করতে রাজি নন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত তিন বছরে সাংগঠনিক অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে। জেলায় জেলায় বর্ধিত সভা, কেন্দ্রীয় নেতাদের কয়েক দফা সাংগঠনিক সফর হয়েছে। সদস্য সংগ্রহ অভিযান চলছে।
কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে জানানো হয়, বর্তমান কমিটি সদস্য সংগ্রহের ৭০ লাখ বই বিক্রি করেছে। সদস্য সংগ্রহ বাবদ দলীয় তহবিলে জমা হয়েছে এক কোটি ৪০ লাখ টাকা।
কমেছে জনপ্রিয়তা: প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও দলের একাধিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, দলের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা এবং সরকার পরিচালনায় নানা ত্রুটিবিচ্যুতি ও ব্যর্থতায় গত সাড়ে তিন বছরে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা অনেক কমেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ক্রমবর্ধমান নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুৎসংকট, শেয়ারবাজারের বিপর্যয় ইত্যাদি। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলেও এর প্রভাব পড়েছে। এসব নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে দলীয় প্রার্থীরা হেরেছেন। হবিগঞ্জে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের আসনও হাতছাড়া হয়েছে। পৌরসভা নির্বাচনে বেশির ভাগ এলাকায় বিরোধী দলের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) নির্বাচনেও ভরাডুবির আশঙ্কায় ছিল দলটির। এই কারণেই মামলা করে নির্বাচন ঝুলিয়ে দেওয়ার নেপথ্যে সরকারের হাত আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে বিভিন্ন জরিপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, দলের ২৩০টি আসনের মধ্যে ২৫-৩০টির অবস্থা খুবই খারাপ। আরও ২৫-৩০টির অর্ধেক সম্ভাবনা আছে।
বেড়েছে কোন্দল: আওয়ামী লীগের সাতটি মহানগর কমিটির মধ্যে পাঁচটিই মেয়াদোত্তীর্ণ। তিন বছরের কমিটি পাঁচ-ছয় বছর আগেই মেয়াদ পার করেছে। বিভাগীয় পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বরিশাল মহানগরে আট বছর ধরে আহ্বায়ক কমিটি। রংপুরে দুই গ্রুপ বেশ কিছুদিন আলাদা মিছিল-সমাবেশ করেছে। ঢাকা মহানগর কমিটিকে ঘিরে তিনটি পক্ষ সক্রিয়। চট্টগ্রাম মহানগরের কোন্দল কদিন পরপর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
অবশ্য আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন দলীয় কোন্দলকে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা বলে দাবি করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা আছে। তাতে কোথাও কোনো সমস্যা হলে তা পারস্পরিক আলোচনায় সমাধান করা হবে।
নারায়ণগঞ্জে অভ্যন্তরীণ কোন্দল আগের মতোই আছে। এস এম আকরাম আহ্বায়কের পদ থেকে পদত্যাগ করার পর নতুন কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের সাংসদ গিয়াসউদ্দিন দলীয় কর্মীদের পিস্তল উঁচিয়ে ধাওয়া করে সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন।
যশোর ও খুলনায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সাংগঠনিক সম্পাদক কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে অবহিত করেছেন। মনিরামপুর উপজেলায় দলীয় সাংসদ খান টিপু সুলতানের সঙ্গে একই দলের উপজেলা চেয়ারম্যান স্বপন ভট্টাচার্যের এবং শার্শা উপজেলায় সাংসদ শেখ আফিল উদ্দিনের সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল মান্নানের বিরোধকে কেন্দ্র করে সেখানে দলের নেতা-কর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কে এম হাসান আলীর সঙ্গে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়ার বিরোধ আছে। রায়গঞ্জে স্থানীয় সাংসদ ইসহাক তালুকদারের সঙ্গে সংগঠনের দূরত্ব আছে। শাহজাদপুরে উপজেলা চেয়ারম্যান হাসিবুর রহমানের সঙ্গে সাবেক পৌর চেয়ারম্যান হালিমুল হকের তীব্র বিরোধ আছে।
বগুড়ায় জেলা কমিটির সভাপতি মমতাজউদ্দিনের সঙ্গে জেলা যুবলীগের সভাপতি মঞ্জুরুল আলম ও সাগর কুমার রায়ের বিরোধ চরমে পৌঁছেছে। সেখানে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে গত তিন বছরে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী খুনও হয়েছেন। এই জেলার নন্দীগ্রাম, শিবগঞ্জ ও গাবতলী উপজেলায়ও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল আছে।
একইভাবে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে জেলার দলীয় চার সাংসদের বিরোধ আছে বলে অভিযোগ আছে। নাটোরের লালপুরে সাবেক সাংসদ মমতাজউদ্দিনের স্ত্রী সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ শেফালী মমতাজের সঙ্গে বিরোধ জেলা সহসভাপতি ও মমতাজের ছোট ভাই আবুল কালাম আজাদের। যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার স্থানীয় নেতা-কর্মী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন বলে দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে। নাটোর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হানিফ আলী শেখ মারা যাওয়ায় সাংগঠনিক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা কমিটির সভাপতি হলেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হক। স্থানীয় নেতারা জানান, দলীয় কার্যক্রমের তিনি নিষ্ক্রিয়। জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাইনুদ্দিন মণ্ডলের সঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের সাংসদ ওয়াদুদ বিশ্বাসের সঙ্গে দ্বন্দ্ব রয়েছে। একইভাবে জয়পুরহাটে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোলায়মান আলীর সঙ্গে সাংসদ মাহফুজা মণ্ডলের বিরোধ আছে।
মৌলভীবাজার জেলা সভাপতি আবদুস শহীদের সঙ্গে জেলার সাবেক সভাপতি সৈয়দ মহসীন আলীর দ্বন্দ্ব। গত পৌর নির্বাচনে এ জেলায় দলীয় সব মেয়র পদপ্রার্থীর পরাজয়ে দলের অন্তর্দ্বন্দ্বকে দায়ী করা হয়। এ জেলায় দলীয় কোনো কর্মসূচিও পালিত হয় না বলে জানা গেছে।
দলীয় এসব কোন্দল সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় কোথাও কোথাও কোন্দলে রূপ নিয়েছে। এটা নিরসনে দলীয় সভানেত্রীর নেতৃত্বে আমরা একযোগে কাজ করছি।’

No comments

Powered by Blogger.