কল্পকথার গল্প-এমন যদি হতো, আহা! এমন যদি... by আলী হাবিব

অঙ্কে যেমন ধরে নেওয়ার একটা ব্যাপার আছে, সে রকম ধরে নেওয়া যাক। ধরে নেওয়া যাক, এক নিরীহ ভদ্রলোকের নাম আবদুর রহিম। আমাদের কল্পনার এই রহিম সাহেব নিতান্তই ছা-পোষা মানুষ। কারো সাতে-পাঁচে নেই। সব সময় একলাটি থাকতেই যেন পছন্দ করেন। অনেকটা শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে রাখেন।


রাস্তায় কোথাও ভিড় দেখলে এড়িয়ে চলেন। ছেলেবেলায় পড়া কবিতার মতো তাঁরও 'মাথায় কত প্রশ্ন আসে'। কিন্তু তিনি কাউকে প্রশ্ন করতে যান না। তিনি নিজের মতো করে নিজের কাছেই প্রশ্ন করেন, উত্তরও খোঁজেন নিজে নিজে। আশাবাদী মানুষ তিনি। নিজের একটি কল্পনার জগৎ আছে তাঁর। নিজের মনে নিজেই কল্পনা করেন সুন্দর একটি দিনের। কিন্তু তাঁর কল্পনার দিন আর আসে না। রোজকার রুটিন আর বদল হয় না তাঁর। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে একবার বাজারে যাওয়ার অভ্যাস তাঁর অনেক দিনের। আগে প্রতিদিন যেতেন। এখন সপ্তাহে দুই দিন বা তিন দিন। শুক্রবার সকালটা বাজারে যাওয়ার জন্য ফিঙ্ড রাখা আছে। একসময় জমিয়ে বাজার করতেন। মহাউৎসাহে কেনাকাটা করতেন। আজকাল বাজারে যান চোরের মতো। কোনোমতে বাজারে ঢুকে বেরিয়ে আসেন। অনেকটা শীতকালে পুকুরে গোসল করার মতো। কোনোমতে একটা ডুব দিতে পারলেই হলো। আবার অফিসে যাওয়ার তাড়াও থাকে। কোনোদিন নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে যাওয়া হয়ে ওঠে না। অফিসের গাড়ি শেষ কবে নির্দিষ্ট সময়ে পেঁৗছেছিল, সেটা আজ গবেষণা করে বের করতে হবে। যানজটে প্রতিদিন আটকে থাকা। একই অবস্থা অফিস থেকে ফেরার পথেও। কিছুই ভালো লাগে না তাঁর। সব কিছুতেই কেমন যেন বিতৃষ্ণা ধরে গেছে। বই পড়তে ভালো লাগে না। খবরের কাগজ একবার চোখ বুলিয়ে রেখে দেন। টেলিভিশনের জমজমাট হিন্দি সিরিয়াল তাঁকে টানে না। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে রহিম সাহেব চুপটি করে বসে থাকেন। পাড়ায় তাঁর বয়সী লোকদের একটা আড্ডা বসে। একসময় নিয়মিত যেতেন। এখন আর সেখানে যেতেও ভালো লাগে না। মাঝেমধ্যে ছেলেমেয়েদের পড়ার টেবিলে গিয়ে বসেন। রাতের খাবার খেয়ে নিরিবিলি ঘুমোতে যান। সকালে ঘুম ভাঙে স্ত্রীর গলা শুনে। আজকাল সকালে গ্যাস থাকে না। সেটা নিয়ে স্ত্রীর অসন্তোষ। ঘুম থেকে উঠে এক কাপ চা চাইবেন। আজকাল সাহসে কুলোয় না। কেমন করে চাইবেন? চুলোয় গ্যাস থাকে না। সকালবেলা নাশতা তৈরি করতেই তো গলদঘর্ম হওয়ার দশা ভদ্রমহিলার। তিনি নিজে অফিসে যাবেন। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাবে। বাথরুমে ঢুকে গোসল করতে গিয়ে অনেক দিনই দেখা যায় পানি নেই। পানির মেশিন ছাড়তে গেলে দেখা যায়, বিদ্যুৎ নেই। সকালবেলাতেই বাড়িটা যেন একটা যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে যায়। তারপর সারা দিনে অফিসের ধকল তো আছেই। সব সামলে সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে ফেরার পর প্রাণশক্তি যেন আর থাকে না।
সে দিনের সকালটা যেন একেবারেই অন্য রকম মনে হলো। না, সকালে স্ত্রীর কণ্ঠস্বর শুনে ঘুম ভাঙল না রহিম সাহেবের। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখলেন স্ত্রীর মেজাজ ফুরফুরে। আজ চুলোয় গ্যাস আছে। বাথরুমে গিয়ে দেখলেন পানির লাইনে পানি আছে। সুইচ অন করে দেখলেন বিদ্যুৎ আছে। অন্য দিনের মতো বাজারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। দেখলেন ডাইনিং টেবিলে তাঁর জন্য চা তৈরি করা আছে। আহ! কত দিন পর চা জুটল সকালে। বাজারের থলেটা হাতে বেরিয়ে যাবেন। স্ত্রী বললেন বাড়িওয়ালাকে ভাড়াটা দিয়ে যেতে। বেতন পেয়েই আগে বাড়ি ভাড়াটা মিটিয়ে ফেলেন তিনি। বড় একটা ঝামেলা চুকে যায় মাসের শুরুতে। বড় অঙ্কের একটা টাকাও বেরিয়ে যায়। রহিম সাহেব বাড়ি ভাড়ার টাকা নিয়ে সিঁড়িতে পা রাখলেন। সাধারণত বাড়িওয়ালার মুখোমুখি হতে চান না তিনি। কেমন একটা চোরের মতো লাগে নিজেকে। যেন বাড়ি ভাড়া নিয়ে অপরাধ করে ফেলেছেন। বাড়িওয়ালা সুযোগ পেলেই বলেন বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর কথা। কোত্থেকে বাড়াবেন, সে চিন্তা তো বাড়িওয়ালার নেই। কাজেই ভয়ে ভয়ে বাড়িওয়ালার ঘরের কলিং বেলে চাপ দিলেন। বাড়িওয়ালা যেন তাঁরই অপেক্ষায় ছিলেন। একবার বেল বাজতেই দরজা খুলে গেল। সহাস্যে রহিম সাহেবকে সম্ভাষণ জানালেন। রহিম সাহেব বাড়ি ভাড়ার টাকাটা এগিয়ে দিতেই টাকা গুনতে শুরু করে দিলেন।
টাকা গোনা শেষ করে জিভ কেটে বাড়িওয়ালা বললেন, 'করেছেন কী! এত টাকা কেন?' রহিম সাহেব বিস্মিত হয়ে বাড়িওয়ালার দিকে তাকিয়ে আছেন। বাড়িওয়ালা বললেন, 'এত পাপ তো করতে পারি না। আমার এই পুরনো বাড়ির ভাড়া তো এত হতে পারে না। এত দিন যা নিয়েছি, অন্যায় করেছি।' বাড়ি ভাড়া কী হতে পারে, সেটা রহিম সাহেবও জানেন। তিনি কিছু বলতে পারেন না। চুপ করে থাকেন। ভাবেন, তিনি ঠিক জায়গাতে এসেছেন তো? এই বাড়িওয়ালাই তো গত মাসে তাঁকে বলেছিলেন বাড়ি ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। তিনি সময় নিয়েছেন। আজ কী হলো? হঠাৎ সব কিছু বদলে গেল নাকি? বাড়িওয়ালা বললেন, 'না রহিম সাহেব। এটা অন্যায়। আমি এত অন্যায় করতে পারব না।' তিনি অনেক টাকা রহিম সাহেবের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, 'আমাকে আর পাপের ভাগী করবেন না। বাজারের দিকে যাচ্ছিলেন বুঝি? যান বাজার করে আনুন। পরে কথা হবে।' সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বাড়িওয়ালার ফিরিয়ে দেওয়া টাকাটা পকেটে ভরতে ভরতে বিস্মিত রহিম সাহেব ভাবেন, এমন যদি হতো...।
বাজারে গিয়ে তাঁর আরেক দফা অবাক হওয়ার পালা। না, বাজারের এই চেহারা তো অনেক দিন দেখেননি তিনি! আজ বাজারের দোকানিরাও যেন বদলে গেছে। অন্য দিন তিনি বাজারে ঢুকলে কেউ তাঁর দিকে ফিরেও তাকায় না। আজ বাজারে ঢুকতে না ঢুকতেই দোকানিরা সমস্বরে ডাকতে শুরু করে দিল। তিনি গিয়ে জিনিসপত্রের দাম করতেই আরেক দফা অবাক হওয়ার পালা। এত কম দামে অনেক দিন কোনো কিছু কেনেননি তিনি। অন্য দিন চোরের মতো বাজার থেকে বেরিয়ে যান। আজ ঘুরে ঘুরে মনের মতো আনাজপাতি কিনলেন। মাছের বাজারে গেলেন। পছন্দের মাছও পেয়ে গেলেন একেবারে কম দামে। ওজনে কম দিচ্ছে না কেউ। রহিম সাহেব কয়েক পদের মাছ কিনে ফেললেন। ব্যাগ ভরে বাজার করে ফিরে এলেন বাড়িতে। কিছুদিন আগে কাকে যেন বলতে শুনেছিলেন, 'আগে পকেট ভরে টাকা নিয়ে গিয়ে ব্যাগ ভরে বাজার করা যেত। আজকাল ব্যাগ ভরে টাকা নিয়ে গিয়ে পকেট ভরে বাজার করতে হয়।' রহিম সাহেব তাঁর স্ফীত ব্যাগ দেখে মনে মনে বললেন, দুর্নামটা আজ ঘুচল। ভাবলেন, সব দিনই যদি আজকের দিনটার মতো হতো! এমন যদি হতো, আহা! এমন যদি হতো...।
স্ত্রীর হাতে বাজারের ব্যাগটা তুলে দিয়ে রোজকার অভ্যেসমতো খবরের কাগজটা তুলে নিলেন হাতে। এক্ষুনি তাঁকে তৈরি হয়ে বের হতে হবে। খবরের কাগজের হেডলাইনগুলোতে চোখ রাখলেন। অবাক হওয়ার মতো ঘটনা। একটাও নেতিবাচক হেডলাইন নেই। এনকাউন্টারের খবর নেই। বাজারে তেল নিয়ে তেলেসমাতি হচ্ছে, কিংবা চাল নিয়ে চালবাজি হচ্ছে_তেমন খবর নেই। দুর্ঘটনার খবর নেই। দখলবাজি, টেন্ডারবাজির খবর নেই। রহিম সাহেব অবাক হয়ে গেলেন। কোনো মন্ত্রবলে কি সব বদলে গেল আজ_ভাবলেন রহিম সাহেব। মনে মনে বলেন, এমন যদি হতো, আহা! এমন যদি হতো...।
খবরের কাগজটা রেখে অফিসের জন্য তৈরি হলেন তিনি। নাশতা খেয়ে বেরিয়ে গেলেন। অফিসের গাড়িতেই রোজ অফিসে আসা-যাওয়া করেন। নির্দিষ্ট গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। বেশ বড় একটা বাস। অনেকের সঙ্গে যাওয়া যায়। বাসে উঠে শুনলেন, কে যেন থানায় গিয়েছিল কোনো এক কাজে। সহজেই কাজটা সারা হয়ে গেছে। পুলিশকে এক পয়সাও দিতে হয়নি। শুনে তো অবাক রহিম সাহেব। পুলিশ আর ঘুষ খাচ্ছে না? এটাও সম্ভব। সবচেয়ে অবাক হলেন, তাঁদের অফিসের বাসটি বড় রাস্তায় আসার পর। এ কী দেখছেন তিনি! রাস্তায় কোনো যানজট নেই। সব গাড়ি চলছে লেন মেনে। মাথার ওপর উড়াল সড়ক হয়েছে। সেই উড়াল সড়ক দিয়ে চলছে গাড়ি। মানুষ হাঁটছে ফুটপাত দিয়ে। নির্দিষ্ট জায়গা দিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছে। ওদিকে চলছে উড়াল রেল। রাজধানী কি স্বপ্নপুরী হয়ে গেল? ভাবলেন রহিম সাহেব। বিশ্বকাপ ক্রিকেট আসছে। তিনি শুনেছিলেন, বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে ঢাকার রাস্তাঘাট যানজটমুক্ত করা হবে। তিনি দেখেন আর অবাক হন। মনে মনে ভাবেন, এমন যদি হতো, আহা! এমন যদি হতো...।
অফিস শেষে বাড়িতে ফিরলেন। কালও সন্ধ্যাবেলা বিদ্যুৎ ছিল না। আজ আছে। বাড়িতে ঢুকলেন। আগের দিনের মতো আর নিজেকে ক্লান্ত লাগছে না। অফিসের জামা-কাপড় ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে আরাম করে টিভির সামনে বসলেন। সব কিছু আজ অন্য রকম লাগছে তাঁর। টিভিতে একটা কমিক শো দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই হেসে উঠলেন। তাঁকে হঠাৎ হেসে উঠতে দেখে সবাই অবাক। রহিম সাহেবও একটু লজ্জা পেলেন যেন। তিনি সবার দিকে তাকালেন। তাকিয়ে বোকা বোকা হাসলেন। মনে মনে বললেন, এমন যদি হতো, আহা! এমন যদি হতো।
হঠাৎ যেন একটা ধাক্কা খেলেন তিনি। ধাক্কা খেয়ে তাঁর ঘোর কেটে গেল যেন। রহিম সাহেব নিজেকে আবিষ্কার করলেন বিছানায়। অর্থাৎ ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি! ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে উঠতে উঠতে রহিম সাহেব ভাবতে থাকেন তাঁর একটু আগে দেখা স্বপ্নের কথা। ভাবেন আর মনে মনে বলেন, এমন যদি হতো, আহা! এমন যদি হতো...। সব কিছু যদি একটু আগে দেখা স্বপ্নের মতো বদলে যেত! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্রুত পা চালালেন বাথরুমের দিকে। আজ নির্ঘাত দেরি হয়ে যাবে। অফিসে রওনা হতে হতেও রহিম সাহেবের স্বপ্নের ঘোর কাটে না। অফিস বাসের সিটে বসে তিনি ভাবেন, বেশ ছিল স্বপ্নটা। সব কিছু যদি স্বপ্নের মতো হতো, বেশ হতো তবে। অমন যদি হতো, আহা! অমন যদি হতো...।

লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.